জয়পুরহাট: মাত্র এক মাস আগেও চিরি নদীর পানি স্বচ্ছ ছিল। তখন আমরা নদীর পানি দিয়ে পাড়ের ফসলি জমিতে সেচ কাজ করেছি।
কালচে রং ধারণ করা, দুর্গন্ধময় চিরি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলছিলেন জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার রুকিন্দীপুর গ্রামের কৃষক আফতাব আলী। তিনি বলেন, চিনিকলের পানি ছেড়েছে। এ কারণে নদীর পানির এই খারাপ অবস্থা হয়েছে।
বর্জ্য মিশ্রিত পানির দুর্গন্ধে আর দূষণে দুর্ভোগে পড়েছেন আফতাব আলীর মতো ২০ গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
জানা গেছে, ১৯৬১ সালে নির্মিত জয়পুরহাট চিনিকল বর্জ্য শোধনাগার ছাড়াই চিনি উৎপাদন করছে। শুরু থেকেই তারা এ কাজ করছে। চিনিকল থেকে একটি নর্দমার মাধ্যমে অপরিশোধিত বর্জ্য নিঃসৃত পানি অপসারণ করা হয়। সেই পানি খাল-বিল হয়ে মিশে যায় নদীতে। এতে নদীর পানি কালচে হয়ে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জয়পুরহাট সদর উপজেলার জামালপুর এলাকা থেকে আক্কেলপুর উপজেলার সোনামুখী পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার নদীর পানি কালচে হয়েছে।
চিরি নদী জয়পুরহাট শহরের খঞ্জনপুর ছোট যমুনা নদীর স্লুইসগেট থেকে আক্কেলপুর উপজেলার সোনামুখী সেতুতে গিয়ে তুলসীগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছে। জয়পুরহাট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি খাল (জয়পুরহাট চিনিকলের খাল বলে পরিচিত) জয়পুরহাট সদর উপজেলার শুকতাহার পুরাতন শ্মশানে এসে চিরি নদীতে মিলিত হয়েছে।
শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) সকালে গিয়ে দেখা যায়, জয়পুরহাট শহরের খাল দিয়ে শুকতাহার পুরাতন শ্মশানে চিরি নদীতে জয়পুরহাট চিনিকলের পানি ঢুকছে। ওই খাল দিয়ে জয়পুরহাট বিসিক শিল্প নগরীর পশ্চিম দিকে খালের পানি কালচে ও স্রোত দেখা গেছে। চিনিকলে গিয়ে বর্জ্য পানির নালার বস্তা দিয়ে বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে বস্তা ভেদ করে নালা দিয়ে পানি যাচ্ছিল।
শুকতাহার গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, জয়পুরহাট চিনিকল প্রতিষ্ঠার পর থেকে খাল দিয়ে জয়পুরহাট চিনিকলের বর্জ্য পানি শুকতাহার পুরাতন শ্মশান এসে চিরি নদীতে পড়ছে। এবারও একইভাবে চিনিকলের বর্জ্য পানি চিরি নদীতে ঢুকে উত্তর দিকের নদীর পানি কালচে হয়েছে। সেতুর দক্ষিণ দিকেও নদীর পানির একই অবস্থা। নদীতে আগে মাছ ছিল। দূষিত পানি ঢোকার পর নদীতে কোনো মাছ নেই।
আক্কেলপুর উপজেলার সোনামুখী গ্রামের নদীপাড়ের বাসিন্দা আয়েশা বেগম বলেন, সুগার মিল চালু হওয়ার পর নদীর পানি কালো হয়ে গেছে। এ জন্য আমরা নদীর পানি সংসারের কাজে ব্যবহার করতে পারি না।
আওয়ালগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল জব্বার বলেন, প্রতি বছরই চিনিকলের পানি ছাড়লে চিরি নদী ও তুলসীগঙ্গা নদীর পানি কালচে ও দুর্গন্ধ হয়। চিনিকলে মাড়াই বন্ধের দেড় থেকে দুই মাস পর নদীর পানি আবার স্বাভাবিক হয়।
চিরি নদীর পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আব্দুল মোত্তালেব বলেন, জয়পুরহাট চিনিকলের বর্জ্যে পানিতে চিরি নদীর পানি কালচে ও দুর্গন্ধময় হয়েছে।
আক্কেলপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বলেন, চিরি নদীর পানি এখন আর সেচ কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সেচ কাজ করলে ফসলের ক্ষতির সম্ভবনা রয়েছে।
এত কিছুর পরও এই দায় স্বীকার করতে নারাজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন, চিনিকলে এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) রয়েছে, যা কারখানার বর্জ্য পানি শোধন করে।
কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আখলাছুর রহমান বলেন, চিনিকলের বর্জ্যমিশ্রিত পানি চিরি নদীতে ছাড়া হয়নি। জামালগঞ্জ এলাকায় পোলট্রি শিল্প রয়েছে। পোলট্রিশিল্পের বর্জ্যে নদীর পানি কালচে ও দুর্গন্ধ হতে পারে। জয়পুরহাট চিনিকলে ইটিপি রয়েছে। চিনিকলের পানি চিনিকলেই সংরক্ষণ করা হয়।
জয়পুরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদ্য বিদায়ী সভাপতি, আক্কেলপুর উপজেলার রুকিন্দীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জামালগঞ্জ বাজারের পোলট্রি খামারি আহসান কবির বলেন, চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কথা সঠিক নয়। পোলট্রি শিল্পের বর্জ্য নদীতে ফেলা হয় না। চিনিকলের পানিতেই চিরি নদীর এই অবস্থা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২৪
এসএম