কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নে পদ্মা নদীর চর থেকে মিলন হোসেন (২৭) নামে এক যুবকের খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কিশোর গ্যাং লিডার এসকে সজিবসহ ছয় যুবককে আদালতে সোপর্দ করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- কুষ্টিয়া শহরের বড়বাজার দেশওয়ালী পাড়ার বাসিন্দা কাজী ফরহাদ হোসেনের ছেলে কাজী লিংকন হোসেন (২৩), হাউজিং সি ব্লক ২৫৩ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা আওলাদ খানের ছেলে ইফতি খান (১৯), আড়ুয়াপাড়া হরিবাসর মোড়ের ২২৯ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা মৃত মিলন শেখের ছেলে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এসকে সজীব (২৪), সদর উপজেলার বোয়ালদাহ গ্রামের বাসিন্দা রফিক প্রামাণিকের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা জনি আহমেদ (১৯), কুমারগাড়া গ্রামের রবিউল ইসলামের ছেলে ফয়সাল আহমেদ (২৫) এবং হাউজিং এস্টেট ডি ব্লকের বাসিন্দা সাইদুল ইসলামের ছেলে মো. সজল ইসলাম (১৯)।
সংশ্লিষ্ট থানার আদালত পুলিশের এসআই ইস্কান্দার জানান, গ্রেপ্তার সজীব ও ইফতি ছাড়া বাকি চারজন আদালতে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে সজীব ও ইফতির রিমান্ড আবেদন করার কথা থাকলেও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এখনও কোনো রিমান্ড আবেদন করেননি।
রোববার (০৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশ অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদা সুলতানার আদালতে সোপর্দ করেছে।
এর আগে ০৩ ফেব্রুয়ারি রাতে নিহত যুবক মিলন হোসেনের মা দৌলতপুর উপজেলার ফিলিফনগর বাহিরমাদি গ্রামের মওলা বক্স সরদারের স্ত্রী শেফালি খাতুন বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৭/৮ জনের বিরুদ্ধে ছেলেকে অপহরণ করে হত্যা শেষে লাশ গুমের অভিযোগ এনে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন বলে নিশ্চিত করেন কুষ্টিয়া আদালত পুলিশের পরিদর্শক জহুরুল ইসলাম। মামলা নম্বর ০৬, তারিখ ০৩/০২/২০২৪। আদালত শুনানি শেষে গ্রেপ্তার ৬ আসামিকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।
তবে যুবক অপহরণ, হত্যা ও খণ্ডিত মরদেহ গুমের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে নিহতের পরিবার তথ্য দিলেও বেনামি এজাহার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নিহতের স্ত্রী মিমি খাতুন।
মিমির অভিযোগ, ‘মিলনকে হাউজিং ডি ব্লকের সজল বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তার সঙ্গী সজিবসহ গ্যাংয়ের লোকজনদের নিয়ে হত্যা করেছে। অপহরণের পর ৩১ জানুয়ারি আমি মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করার সময় পুলিশকে জানিয়েছি। আমি জানানোর পরও পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে মিলনকে উদ্ধারের চেষ্টা করেনি। পরে মিলনের মোবাইল ফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে সজল ও সজিবকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে গ্রেপ্তার সজল, সজীব ও জনির দেখিয়ে দেওয়া স্থান থেকেই তো পুলিশ লাশ উদ্ধার করেছে’। লাশ পাওয়ার পরই আমার শাশুড়িকে বাদী করে থানায় বেনামি এজাহার করিয়ে মামলা নিয়েছে পুলিশ’।
এদিকে পুলিশ বলছে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরাই মিলন হত্যার সঙ্গে জড়িত, আবার একই সময়ে অজ্ঞাতনামা বা বেনামি এজাহারে মামলা নিয়েছে পুলিশ।
অজ্ঞাতনামা এজাহার বিষয়ে মামলার বাদী নিহত মিলনের মা শেফালি খাতুনের সঙ্গে কথা বলতে তার মোবাইল ফোনে কল দিলে রিসিভ করেন নিহতের বোন সেলিনা খাতুন। তিনি বলেন, ‘ঘটনা যা কিছু হয়েছে তার সব আমরা বসে থেকে বলেছি, পুলিশ টাইপ করেছে, পুলিশ কি টাইপ করেছে সেসব আমরা জানি না’।
এসময় মামলার বাদী শেফালি খাতুনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে অপেক্ষা করেন ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে তারপর আপনাকে জানাবো’। বলেই ফোন কেটে দেন, পরে অসংখ্যবার কল করলেও তারা কল রিসিভ করেননি।
২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর শহরের সাদ্দাম বাজার এলাকার বাসিন্দা চালকল মালিক লোকমান হোসেনের ছেলে সোহানকে (২২) অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় করা মামলার বাদী লোকমান হোসেনের অভিযোগ, ‘রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের সরাসরি মদদে এসকে সজীব গত ১০ বছরের মধ্যে এখন ভয়ংকর গ্যাং লিডার হয়ে উঠেছে’। গুরুতর অপরাধ করেও বার বার আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে এসে শহর দাপিয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে’ কারো কিছু বলার নেই’।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুষ্টিয়া গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ‘সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সজিবের নেতৃত্বে কুষ্টিয়া শহর ও আশপাশে একাধিক গ্যাং রয়েছে। এরা হত্যা, ব্লাকমেইল (কৌশলে জিম্মি), মোবাইল নাম্বার ক্লোন বা হ্যাক করে বিকাশ অ্যাকাউন্টের টাকা আত্মসাৎ, অস্ত্র, মাদক ও নারী ব্যবসাসহ নানা অপরাধ সংঘটনে জড়িত। এদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, কথিত সাংবাদিক, উকিল এমনকি আদালতেরও কিছু কর্মচারীর সখ্যতা ও সম্পৃক্ততা রয়েছে। এদের শিকর অনেক গভীরে। কিশোর গ্যাং লিডার খ্যাত সজিবের বিরুদ্ধে অনেকগুলি মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পলাশ কান্তি নাথ বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর মিলন হত্যা মামলার এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামি থাকলেও পুলিশের তৎপরতায় ইতোমধ্যে জড়িত ছয় আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। তাছাড়া গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের মধ্যে চারজনই আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়াতেই এরা এখন এজাহারভুক্ত হয়ে যাবে’। তবে এ মামলায় আরও যারা জড়িত আছে তাদেরও আইনের আওতায় আনতে এবং তদন্তের কৌশলগত কারণে এজাহারে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। এছাড়া সজীব ও ইফতি নামের আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া হবে’।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২৪
আরএ