সিলেট: বিষে মলিন কিশোরী মাছুমা বেগমের অবয়ব। শয্যাশায়ী হাসপাতালে।
নিহত কিশোরী ওসমানীনগর উপজেলার ধনপুর গ্রামের আব্দুল কালামের মেয়ে ও স্থানীয় মাজার বাজার হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
নিহতের বাবা আব্দুল কালাম জানান, মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) দুপুরে তার মেয়ে মাছুমা পাশের বাড়ি তার ফুফাতো ভাইয়ের মৃত আব্দুল কাদিরের স্ত্রী আসমা বেগমের ঘরে যায়। তখন আসমা তার পুত্রবধূ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নিপা বেগমের সামনে আমার মেয়েকে শরবত পান করায়। বিষপান করানোর ঘটনাটি দেখেছেন নিপাও। বাড়িতে ফিরে তার মেয়ে সবুজ বর্ণের বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। গুরুতর অবস্থায় তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার (২২ মার্চ) সকাল সাড়ে ৭টায় মাছুমা মারা যায়।
মৃত্যুর আগে মাছুমা তার স্বজনদের কাছে বলে যায়, চাচি আসমার ঘরে সে বেড়াতে যায়। সেখানে তাকে শরবতের সঙ্গে বিষপান করানো হয়েছে। বাড়ি ফেরার পর মাছুমার মা মেয়েকে সবুজ বর্ণের বমি করতে দেখে জানতে চায় কি হয়েছে। তখন সে জানায় চাচির দেওয়া শরবত পান করে অসুস্থ হয়েছে। কথা বলতে পারছে না। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাছুমা বলে যায় চাচি তাকে শরবতের সঙ্গে বিষপান করিয়েছেন।
এদিকে কিশোরীর বিষপানে মৃত্যুর ঘটনায় ওসমানীনগর থানায় বেতার বার্তা পাঠায় কোতোয়ালি পুলিশ। ওসমানীনগর থানা পুলিশ ঘটনাটি জানতে পেরে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাশেদুল হক খতিয়ে দেখতে উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুর উদ্দিনকে দায়িত্ব দেন। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং নিহতের স্বজনদের থানায় আসতে বলেন।
নিহতের বাবা আব্দুল কালাম বলেন, শনিবার (২৩ মার্চ) সকাল ১১টায় তাকে থানায় নিয়ে ঘণ্টাখানেক বসিয়ে একটি কাগজে সই রাখা হয়। এ ঘটনায় উল্টোরথে হাঁটছিল থানা পুলিশ। বিষপান করিয়ে হত্যার ঘটনাটি অপমৃত্যুর মামলা নিয়ে দায়মুক্ত হতে চেয়েছিল পুলিশ। ঘটনাটি বুঝতে পেরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দ্বারস্থ হন ভুক্তভোগীরা। পরে শনিবার রাতে ঘটনাটি অন্যদিকে মোড় নেয়।
মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ কি ব্যবস্থা নিয়েছে, এ বিষয়ে আব্দুল কালাম বলেন, আমাকে ডেকে থানায় আনা হয়েছে। অপমৃত্যুর মামলা কি না, সে বিষয়ে কোনো কিছু বলতে পারবো না। তবে মেয়ের ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশ আমার সই নিয়েছে বলে জানিয়েছে।
এ বিষয়ে ওসমানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশেদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনাটি জানতে পেরে তদন্ত করতে একজন কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছি। তবে অপমৃত্যুর মামলা নেওয়া হয়নি। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি।
ঘটনার তদন্তে যাওয়া উপ-পরিদর্শক নুর উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, কিশোরীর মৃত্যুর ঘটনায় খবর নিয়েছি। কিন্তু অপমৃত্যুর মামলা রেকর্ড করা হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিহত কিশোরীর বাবাকে ডেকে থানায় এনে অপমৃত্যু দরখাস্তে সই নিয়েছি। পরে পুরো বিষয়টি জানতে পেরে মামলাটি রেকর্ড করা হয়নি।
তিনি বলেন, বিষপানের বিষয়টি থানায় অবহিত করা হয়নি, বিধায় আমি নিহতের বাড়িতে গিয়ে ধমক দিয়েছি। বিষপানের ঘটনাটি থানায় জানানো হয়নি কেন? তাদের কাছ থেকে তথ্য জানার চেষ্টা করেছি, কেউ কিছু বলতে পারেনি। পরে মৃত্যুর আগে কিশোরীর জবানবন্দির ভিডিওটি হাতে পেয়েছি। আগে জানলে আমরা মেয়েটির বক্তব্য রেকর্ড করতাম। এরপর সন্ধ্যায় মেয়ের চাচা সালাম ও স্থানীয় মামুন নামের এক ব্যক্তিসহ মেয়ের বাবা থানায় আসেন। রোববার (২৪ মার্চ) থেকে এই ঘটনার তদন্ত শুরু হবে। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি। অভিযুক্ত আসমা বিষপান করানোর দিন থেকেই বসতঘর তালাবদ্ধ করে পলাতক রয়েছেন।
নিহত কিশোরীর মা বলেন, আমার মেয়েকে বিষপান করানোর জবানবন্দি অনুযায়ী ঘটনাস্থলে বিষের বোতল পাওয়া যায়। সেটি সংরক্ষণে আছে। তার মেয়েকে বিষপান করিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এদিকে রমজানের আগের দিন ১১ মার্চ পারিবারিক কলহে আসমা বেগমের ছেলে হাফিজ আলমগীর বিষপানে নিজ বসতঘরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আলমগীরের মায়ের তার স্ত্রীর বনিবনা ছিল না বিধায় পিত্রালয়ে চলে যায়। আলমগীরের মৃত্যুর পর পুলিশ তার একটি চিরকুট উদ্ধার করে। তাতে লেখা ছিল, মা ও স্ত্রীর পারিবারিক কলহের কারণে তিনি বিষপান করেছেন।
বাংলানিউজকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শফিকুল ইসলাম। তবে চিরকুটটি আলমগীরের হাতের লেখা বলে নিশ্চিত করেছেন এই তদন্তকারী কর্মকর্তা। মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে মৃত আলমগীরের স্ত্রী আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ওই ঘটনাটি তদন্তক্রমে আদালতে অপমৃত্যুর প্রতিবেদন দিয়েছি।
একই ঘরে পর পর দুইটি বিষপানের ঘটনায় জনমনে কৌতূহল দেখা দিয়েছে। বিষয় দুটি একই সূত্রে গাঁথা কি না এমন প্রশ্নও উঠেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০১ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০২৪
এনইউ/এএটি