ঢাকা: ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী ৪৭০ জন চেয়ারম্যানের মধ্যে ২২৭ জনের কোটি টাকার অধিক সম্পদ রয়েছে। শতকরা হিসেবে যা ৪৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন হলে আয়োজিত ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের তথ্যের বিশ্লেষণ উপস্থাপন এবং নির্বাচন মূল্যায়ন শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পাঁচটি ধাপে মোট ৪৭০ জন প্রার্থী উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। তাদের মধ্যে ১৫ জনের (৩.১৫ শতাংশ) সম্পদ পাঁচ লাখ টাকার কম, ৯৭ জনের (২০.৬৪ শতাংশ) সম্পদ পাঁচ লাখ এক টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকা, ৫৮ জনের (১২.৩৪ শতাংশ) সম্পদ ২৫ লাখ এক টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা, ৭২ জনের (১৫.৩২ শতাংশ) সম্পদ ৫০ লাখ এক টাকা থেকে এক কোটি টাকা, ১৫৮ জনের (৩৩.৬২ শতাংশ) সম্পদ এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকা এবং ৬৯ জনের (১৪.৬৮ শতাংশ) সম্পদ পাঁচ কোটি টাকার অধিক। এছাড়া নির্বাচিত একজন চেয়ারম্যান (০.২১ শতাংশ) তার সম্পদের ঘর পূরণ করেননি।
তিনি আরও বলেন, স্বল্প সম্পদের মালিক (২৫ লাখ টাকার কম) ৩৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তাদের মধ্যে ২৪ দশমিক ০৪ শতাংশ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া অধিক সম্পদের মালিক (২৫ লাখ টাকার বেশি) ৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তাদের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৩০ শতাংশ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভোটাররা স্বল্প সম্পদের মালিকদের তুলনায় অধিক সম্পদের মালিকদের চেয়ারম্যান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পাশাপাশি স্বল্প সম্পদের মালিকদের কিছুটা হলেও বর্জন করেছেন। নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করেন বাংলাদেশে নির্বাচন দিন দিন টাকার খেলায় পরিণত হচ্ছে।
বিজয়ী চেয়ারম্যানদের মধ্যে শীর্ষ ১০ সম্পদশালীর নামও প্রকাশ করেছে সুজন। এর মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ফেরদৌসী ইসলাম। তার সম্পদের পরিমাণ ১৮৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি। এরপরে যথাক্রমে রয়েছেন পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মিরাজুল ইসলাম (৮১ কোটি ৯৬ লাখ), কুমিল্লার হোমনা উপজেলার চেয়ারম্যান রেহানা বেগম (৭৩ কোটি ৩৩ লাখ), হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার চেয়ারম্যান এস এফ এ এম শাহজাহান (৪২ কোটি ৫৩ লাখ), চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জাহেদুল হক (৩৭ কোটি ৭০ লাখ), ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান মজুমদার (৩৪ কোটি ৮২ লাখ), শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার চেয়ারম্যান মো. ইদ্রিস ফিরোজ (৩৩ কোটি ১৬ লাখ), ঝালকাঠির সদর উপজেলার চেয়ারম্যান খান আরিফুর রহমান (২৮ কোটি ৪৪ লাখ)।
দিলীপ কুমার সরকার আরও বলেন, প্রার্থীদের সম্পদের হিসাবের যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে কোনোভাবেই সম্পদের প্রকৃত চিত্র বলা যাবে না। কেননা, প্রার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই প্রতিটি সম্পদের মূল্য উল্লেখ করেন না, বিশেষ করে স্থাবর সম্পদের। আবার উল্লিখিত মূল্য বর্তমান বাজার মূল্য নয়, এটি অর্জনকালীন মূল্য।
নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও নির্ভরশীলদের বাৎসরিক আয়ের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, বিজয়ী সর্বমোট ৪৭০ জন প্রার্থীর মধ্যে আট জনের (১.৭০ শতাংশ) প্রার্থীর বার্ষিক আয় দুই লাখ টাকার কম, ১২৪ জনের (২৬.৩৮ শতাংশ) দুই লাখ এক টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা, ২০৪ জনের (৪৩.৪০ শতাংশ) পাঁচ লাখ এক টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকা, ৫১ জনের (১০.৮৫ শতাংশ) ২৫ লাখ এক টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা, ৩৬ জনের (৭.৬৬ শতাংশ) ৫০ লাখ এক টাকা থেকে এক কোটি টাকা এবং ৪২ জনের (৮.৯৪ শতাংশ) এক কোটি টাকার অধিক।
সংবাদ সম্মেলনে বিজয়ী প্রার্থীদের দায়-দেনা ও ঋণ সংক্রান্ত তথ্য সম্পর্কে বলা হয়, ৪৭০ জন বিজয়ী প্রার্থীর মধ্যে ১৫৭ জন (৩৩.৪৪ শতাংশ) ঋণ গ্রহীতা। এর মধ্যে কোটি টাকার অধিক ঋণ গ্রহণ করেছেন ৫৭ জন চেয়ারম্যান (৩৬.৩১ শতাংশ)। ঋণ গ্রহীতাদের নির্বাচিত হওয়ার হার প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় বেশি।
নির্বাচিতদের আয়কর প্রদান সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের মধ্যে ৩৭৪ জন (৭৯.৫৭ শতাংশ) আয়কর দেন করেন। এর মধ্যে ৮৩ জন (১৭.৬৬ শতাংশ) প্রার্থী পাঁচ হাজার টাকার নিচে কর দেন। লক্ষাধিক টাকার বেশি আয়কর দেন ১৫৮ জন (৩৩.৬২ শতাংশ) চেয়ারম্যান। প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় নির্বাচিতদের মধ্যে আয়কর প্রদানকারীদের হার বেশি।
বিজয়ী চেয়ারম্যানদের মামলা সংক্রান্ত তথ্যে বলা হয়, নির্বাচিত সর্বমোট ৪৭০ জন বিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে ১১৪ জনের (২৪.২৬ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে, ১৮২ জনের (৩৮.৭২ শতাংশ) বিরুদ্ধে অতীতে এবং ৭৫ জনের (১৫.৯৬ শতাংশ) অতীতে মামলা ছিল এবং বর্তমানেও আছে। ৩০২ ধারার মামলার ক্ষেত্রে ২৫ জনের (৫.৩২ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে, ৩৬ জনের (৭.৬৬ শতাংশ) বিরুদ্ধে অতীতে এবং চারজনের (০.৮৫ শতাংশ) অতীতে মামলা ছিল এবং বর্তমানেও আছে।
বিজয়ী প্রার্থীদের পেশা সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পাঁচটি ধাপে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত সর্বমোট ৪৭০ জন বিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে ৩৬০ জন (৭৬.৬০ শতাংশ) ব্যবসায়ী, ৪৮ জন (১০.২১ শতাংশ) কৃষিজীবী, সাতজন (১.৪৯ শতাংশ) চাকরিজীবী এবং ১৯ জন (৪.০৪ শতাংশ) আইনজীবী। এছাড়াও একজন (০.২১ শতাংশ) গৃহিণী এবং ২৮ জন (৫.৯৬ শতাংশ) অন্যান্য পেশার সঙ্গে জড়িত। সাতজন (১.৪৯ শতাংশ) পেশার ঘর পূরণ করেননি। অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে ১৫ জন (৩.১৯ শতাংশ) রয়েছেন শিক্ষক।
এ বিষয়ে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় ব্যবসায়ীদের নির্বাচিত হওয়ার হার বেশি। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৬৭.৬৬ শতাংশ ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচিতদের মধ্যে এ হার ৭৬.৬০ শতাংশ। এর অর্থ অন্যান্য পেশার তুলনায় ভোটাররা ব্যবসায়ীদের বেছে নিয়েছেন বেশি। অন্যান্য নির্বাচনের মতো উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৌড়েও ব্যবসায়ীরা এগিয়ে রয়েছেন। এ প্রবণতা ব্যবসায়ীদের সরাসরি নির্বাচনী রাজনীতিতে অধিক হারে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষণ।
দেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধকরণের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন সুজন। এজন্য বেশ কিছু সুপারিশও করে সংস্থাটি। তাদের সুপারিশগুলো হলো- নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধকরণ এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণের জন্য প্রয়োজন বড় ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার। রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্য ও সমঝোতা। আর এ সমঝোতার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা ও সংলাপ। নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা নির্ধারণের বিষয়ে ঐক্যমতে আসতে হবে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়টি সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা মনে করে, ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে আমরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ’। সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষার আলোকে আমাদের দেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আইনগুলো সংশোধন করতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনগুলো নির্দলীয় ভিত্তিতে সংসদীয় পদ্ধতিতে করতে হবে। উপজেলা পরিষদকে দ্বৈতশাসনমুক্ত করতে হবে এবং উপজেলা পরিষদের নির্বাহী ক্ষমতা চেয়ারম্যানের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সদস্য সচিব হিসেবে পরিষদের সার্বিক কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করবেন। সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টার পদ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে এবং স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে তাদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করতে হবে। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য জামানতের টাকা আগের মতো দশ হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা করতে হবে। জেলা পরিষদ নির্বাচন মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে না করে সাধারণ ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে আয়োজন করতে হবে। সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি একীভূত আইন (আমব্রেলা অ্যাক্ট) করতে হবে এবং ব্যয় সংকোচনসহ অনেক ধরনের জটিলতা পরিহারের জন্য একই সঙ্গে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আপনারাও জানেন আমরাও জানি নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে ব্যবসায়ীর মূল সংখ্যাটা আরও বেশি। ব্যবসায়ী হতে পারে তাতে সমস্যা নেই। তবে এখানে টাকার খেলা থাকলে সমস্যা। যদি টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনে ভোট কিনে।
ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘যা দেখানো হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে, প্রশ্ন আছে? তাও সন্তোষজনক না। ৫০ শতাংশ পার হয়নি।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি যা বলা হয়েছে তা ছিল কি না বলে সংশয় প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে ভোটারদের অনীহা ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো ভোট বর্জন করছে। এটা একই সুতোয় গাঁথা। মূল কারণ হলো আস্থাহীনতা। জনগণের আস্থাহীনতা নির্বাচন কমিশনের ওপর।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও সুজনের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কৌশলগত দিক ছিল আওয়ামী লীগের। সেখানে তারা কিছুটা হলেও সাকসেসফুল।
বিরোধীদলের স্থানীয় সরকারের ভোটে অংশ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, নির্দলীয় হিসেবে ব্যক্তি হিসেবে এসে তারা নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করে নিতে পারতেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সুজনের জাতীয় কমিটির সদস্য একরাম হোসেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০২৪
এসসি/আরআইএস