ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

নদী ভাঙনে বিলীনের পথে শ্রীপুর ইউনিয়ন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১১ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০২৪
নদী ভাঙনে বিলীনের পথে শ্রীপুর ইউনিয়ন

বরিশাল: উত্তাল কালাবদর ও তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙনে দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়ন। এরই মধ্যে ইউনিয়নের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি, বিভিন্ন স্থাপনা নিয়ে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড পুরোপুরি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, সেইসাথে আরও বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড বিলীনের পথে।



শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশীদ বলেন, প্রতিনিয়ত নদীর ভাঙনে দিশেহারা এ অঞ্চলের মানুষ। প্রতিনিয়ত বসতভিটাসহ আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে এ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি পাকা সরকারি ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ভূমি অফিস, স্কুল-মাদ্রাসার ভবনও রয়েছে। এছাড়া বাহেরচর ও শ্রীপুর বাজারও নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙনের শিকার মানুষগুলোকে তাৎক্ষণিক সরকারি সহায়তা দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।



খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রীপুর ইউনিয়নে ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে বাহেরচর ফেনুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবনটি চলতি বছর নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে আর ২১৩ শিক্ষার্থীকে ভাড়া করা বাসায় নিয়ে পাঠদান করানো হচ্ছে। আর নদীতে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় আছে ৩৮৭ শিক্ষার্থীর চরফেনুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি ভবন এবং ২৩৫ শিক্ষার্থীর শ্রীপুর সরকারি (নব) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ভবন।

শ্রীপুর সরকারি (নব) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মরিয়মুন্নেছা মুক্তা বলেন, ২০১৮ সালে এই স্কুলে যখন আমি যোগদান করি তখন লঞ্চঘাট থেকে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসতে ৪০ মিনিট সময় লাগতো আর এখন লাগে এক মিনিট।  জায়গা সংকুলান না হওয়ায় চারতলা ভিতের দোতলা এই ভবনটি উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের জন্য কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু নদী কাছে থাকায় সেটি আর হয়নি, তবে অন্য জায়গায় একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে রাখা হয়েছে।

এদিকে ২০২০ সালে চরবগী চৌধুরীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উম্মে কুলসুম জানান, এখন মূল শ্রীপুর থেকে আলাদা হয়ে নদীর অপরপ্রান্তে বিদ্যালয়টি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে এখন আর ভবন নয়, টিনশেড ঘরে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। সেইসাথে নদীতে বিলীন হওয়ার আগে ৩শ শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠানটিতে এখন মাত্র ১২৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।



কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ২০১৯-২০২০ সালে শুধু বিদ্যালয়টি নয়, এর আশপাশের এলাকার বহু বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সেই সব বাড়ির সন্তানরাই আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল। নদীর ভাঙনের কারণে তারা অন্যত্র যেমন চলে গেছে, তেমনি বিদ্যালয়টিও সরে গেছে। ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন অন্য কোথাও পড়াশোনা করছে। তবে যারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায় তাদের গল্পটা ভিন্ন হয় এখানে।

২০১৭ সালের দিকে বাহেরচর শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ও পুরাতন দুটি ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিলীনের আগে যে বিদ্যালয় তিন শতর বেশি শিক্ষার্থী ছিল এখন কাঠের পোল নামক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়ে ১২৯ জন শিক্ষার্থীর পাঠদান করান শিক্ষকরা।  

এর কয়েক বছর পরে শ্রীপুর মহিষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন নদীতে বিলীন হয়ে গেলেও নতুন ভবনটি নিলামে বিক্রি সম্ভব হয়েছিল বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক রিনা আক্তার।

তিনি বলেন, এখন নতুন জায়গায় বিদ্যালয়টি একটি টিনশেড ঘরে পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে দুটি ক্লাসরুমে ১১২ জনের পাঠদান করানো হয়। তবে ভাঙার আগে এই বিদ্যালয়ে ৩ থেকে ৪শ শিক্ষার্থী ছিল।



তার মতে শুধু প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের কারণে কৃষক ও জেলে অধ্যুষিত শ্রীপুরে মানুষের জীবনমান প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। ভিটেমাটিসহ সবকিছু হারিয়ে অনেকেই পড়াশুনা ছেড়ে জীবিকার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

এদিকে স্থানীয়রা জানান, শুধু প্রাথমিক নয়, বহু দাখিল ও কওমি মাদ্রাসা, মসজিদও বিলীন হয়ে গেছে কালাবদর-তেঁতুলিয়ার বুকে। আর এখন বাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি নদীর ভাঙনের মুখে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে শ্রীপুর মহিষা ওয়াহেদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নতুন-পুরাতন দুটি ভবন, টিনশেড তিনটি আধাপাকা ঘর।


স্থানীয় বাসিন্দা সত্তোরোর্ধ্ব আব্দুস ছত্তার খান ও তরুণ প্রজন্মের নাজমুস ছাকিব হিসেবে মিলিয়ে জানান, গেল কয়েক বছরের ভাঙনে শুধু শ্রীপুর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের (চরবগি) ৭০ শতাংশ, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের (চরফেনুয়া) ৫০ শতাংশ ও ৯ নং নম্বর ওয়ার্ডের ৫০ শতাংশের বেশি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সেইসাথে এ ইউনিয়নের সার্বজনীন মন্দিরসহ ২ নম্বর ওয়ার্ড (পশ্চিম শ্রীপুর) ও ৪ নম্বর ওয়ার্ড (বাহেরচর) পুরোপুরি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) পঙ্কজ নাথ বলেন, সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকার পরে শ্রীপুরের ভাঙন রোধ করা যায়নি। গত কয়েক বছরে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কয়েকবার পরিদর্শন করেছেন। বরাদ্দ দিয়েছেন, ড্রেজিং করে খনন করে দিয়েছেন কিন্তু স্রোত এসে এমনভাবে ধাক্কা দেয় যেন কিছু করার থাকে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১২ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০২৪
এমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।