ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০২৪
সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’ ফয়সালের মা-বোনের আহাজারি, ইনসেটে ফয়সাল

কুমিল্লা: ধবধবে একটি সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না। ’ এমন একটি ছবি হাতে নিয়ে বুক চাপড়ে বিলাপ করছেন নিহত ফয়সালের মা হাজেরা বেগম।

তার চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। পাশে বসে কাঁদছেন ফয়সালের বাবাসহ তার ছয় বোন ও আত্মীয়-স্বজন। তাদের শোকে কাঁদছেন প্রতিবেশীরাও।  

গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে ফয়সালের মা হাজেরা বেগম বলছেন, আমার ছেলের জীবনডারে কেউ ভিক্ষা দাও, আহারে আমার নিমাইরে এমনভাবে গুলি করছে যে মাথা-মগজও উড়ে গেছে। কোন পাষণ্ড আমার ছেলেরে এমনে গুলি করল, তার কি একটুও হাত কাঁপল না? 

তিনি আরও বলেন, 'পোলারে কত জায়গায় খুঁজছি, কেউ বলতে পারেনি কই আছে, থানায় গেছি, এই হাসপাতালে, ওই হাসপাতালে ঘুরছি, কোথাও পাইনি। ১৩দিন পর জানছি, আমার ছেলেরে বেওয়ারিস লাশ হিসেবে দাফন করছে। আমার মানিক চানরে কই দাফন করছে তাও কেউ জানি না। কবরে দাঁড়াইয়া যে ফয়সাল বইল্ল্যা ডাক দিমু তাও পারমু না। আহারে ফয়সালরে তুই গিয়া শুইয়্যা আছস, আমার বুকে আয় বাবা। ’ 

শুক্রবার (২ আগস্ট) ফয়সালের বাড়িতে গিয়ে এমনই আর্তনাদের চিত্র দেখতে পান সাংবাদিকরা।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ফয়সাল সরকার। ঘটনাটি ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায়। পরে ২২ জুলাই থেকে ২৫ জুলাইয়ের কোনো এক সময় বেওয়ারিস লাশ হিসেবে ফয়সালকে ঢাকায় গণকবর দেওয়া হয়। ১ আগস্ট পরিবারের লোকজন জানতে পারেন ফয়সালকে বেওয়ারিস লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে।

নিহত ফয়সাল সরকার কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর গ্রামের সরকার বাড়ির মো. সফিকুল ইসলাম সরকারের ছেলে। চলতি বছরে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল সে।  ইতোমধ্যে আট বিষয়ে পরীক্ষা শেষ করেছিল। পাশাপাশি সংসারের অভাব ঘুচাতে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করত। বাবা-মা, ভাইসহ পরিবার নিয়ে থাকত আবদুল্লাহপুর এলাকার একটি ভাড়া বাসায়।  

ফয়সালের ছোট ভাই ফাহাদ সরকার বলে, গত ১৯ জুলাই বিকেলে আবদুল্লাহপুরের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে যাবে বলে বাসা থেকে বের হয়। সন্ধ্যার পর ভাইয়ের নম্বরে ফোন করলে বন্ধ পাই। এরপর আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি শুরু করি। বাইরে তখনও গোলাগুলি চলছিল। কোথাও খোঁজ না পেয়ে ২৮ জুলাই দক্ষিণ খান থানায় জিডি করি। গত ১২দিন ঢাকার এই হাসপাতালে ওই হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেছি, কোথাও হদিস পাইনি। বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিকেলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে খোঁজ নিলে তারা বেওয়ারিস হিসেবে দাফন করা মরদেহগুলোর ছবি দেখালে সেখানে ফয়সাল ভাইয়ের মরদেহের ছবি দেখতে পাই। কোথায় দাফন করা হয়েছে জানতে চাইলে তারা জানায়, ১৫-২০টি লাশ একবারে গণকবর দেওয়া হয়েছে, কাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে তারা তা জানেন না।

ফয়সালের বড় বোন রোজিনা আক্তার ও নুরুননাহার আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমাদের ছয় বোনের পর এই ভাই। আপনারা আমার ভাইকে এনে দেন। আমরা কোনো রাজনীতি করি না। আমাদের সংসার এখন কে চালাবে? আমাদের কি হবে? এই ভাই রোজগার করে বোনদের বিয়ে দিয়েছে।  

ফয়সালের বাবা বৃদ্ধ মো. সফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, আমার ছয় মেয়ের পর ফয়সালের জন্ম। ফয়সাল লেখাপড়ার পাশাপাশি শ্যামলী বাসে পার্টটাইম সুপারভাইজারের কাজ করে সংসার চালাত। এখন আমার পুরো সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। কারা আমার ছেলেকে হত্যা করল? কী দোষ ছিল আমার ছেলের? সে তো রাজনীতি করত না, পেটের দায়ে বাসে কাজ করত। তাকে কেন গুলি করে মারা হলো? এই বিচার আমি কার কাছে দেব?

দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, ১৩দিন পর ফয়সালের মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছি। শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। এর আগেও ঢাকায় নিহত কয়েকজনের বাড়িতে আমি গিয়েছি, সহযোগিতা করেছি। ফয়সালের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হবে। সরকারিভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।