সিরাজগঞ্জ: আড়াই বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন আমিনা খাতুন (৫০)। স্বামী হারানোর ছয় মাস পর যমুনায় বিলীন হয় বসতভিটা।
১৪ বছর বয়সী ছেলে হানিফ লেখাপড়া বাদ দিয়ে সংসারের হাল ধরেছে, নদীতে জেলেদের জাল ঠেলে দিনে এক-দেড়শ টাকা পায়, সেটা দিয়ে কোনো মতে সংসার চলে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাট পাচিল এলাকায় পাউবোর বাঁধের ঢালে এক আত্মীয়ের তোলা ঝুপড়ি ঘরে ছেলেমেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে বাস করছেন আমিনা।
হাট পাচিল এলাকায় গেলে আমিনা খাতুনের দুরাবস্থার চিত্রই চোখে পড়ে। মাথার ওপরে চাল থাকলেও নেই কোনো বেড়া, এমনই একটি ঘরে তিনি বসবাস করছেন।
তিনি বলেন, দুই মেয়ে ও এক ছওয়ালের মধ্যে বড় মেয়েকে বিয়্যা দিচি। ছোট মেয়ে সিক্সে উইটচে, অ্যাহন পড়াশোনাও বন্ধ অই্যা গেছে। ছওয়ালডা দিনে একশ-দেড়শ ট্যাহা কামাই করে, ওই দিয়্যা কুনমতে সংসার চলে। ছওয়াল-মেয়ে আর শাশুড়ি রত্না বেগমকে নিয়্যা মামা শ্বশুরের ছেলের ঝুপড়ি ঘরে কয়দিন ধইর্যা আচি।
তিনি বলেন, আমার কিচ্চু চাই না, পায়ের তলায় যদি অ্যাল্লা মাটি অইতো........।
কয়েক পা এগিয়ে যেতেই এমন আরেকটি ঝুপড়ি ঘর। ঘরের সামনে খোলা আকাশের নিচে রান্না করছিলেন আসমা খাতুন নামে এক নারী। বছর চারেক আগে তার স্বামী দিনমজুর আব্দুর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তারও অনেক আগে যমুনায় চলে গেছে বাড়িঘর। ভূমিহীন হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি। ময়দার ঝুরি (এক ধরনের খাবার) বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
আসমা বলেন, নদীতে বাড়িঘর ভাইঙ্যা গেচে। ওয়াপদায় বসবাস করি। তিনটা ছওয়ালপাল নিয়্যা বিধবা অইচি। দিন কামাই কইর্যা দিন খাই, মাথার ওপর ছাদ নাই। হারাদিন অন্তর রাইনত্যাচি। ছওয়ালগোলে লেহ্যাপড়া করামু ক্যাবা কইর্যা। ঘরবাড়িও নাই, ট্যাহা-পয়সা নাই।
তিনটি ঘর পেরোলে দেখা যায়, শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ২০ বছর বয়সী সখিনা।
তিনি বলেন, শ্বশুরের বাড়ি ছিল। স্বামী-সন্তান নিয়ে সবাই ওই বাড়িতে মিলেমিশে থাকতাম। যমুনার ভাঙনে শ্বশুরবাড়ি বিলীন হওয়ার পর যার যার মতো এক এক জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি। রিকশাচালক স্বামীকে নিয়ে তিনিও বাঁধের ঢালে ঘর তুলে বাস করছেন। খোলা আকাশের নিচে রান্না করতে হচ্ছে, বিদ্যুৎ নাই, বাতিও নাই। প্রচণ্ড গরমে তালপাখার বাতাসে কষ্টে রাত কাটে আমাদের।
কৃষি দিনমজুর মোহাম্মদ আলী সরকার বলেন, ১২ শতক জমিতে বাড়ি ছিল। দেড় বছর হলো সেটা যমুনায় বিলীন হয়েছে। এখন আমি বাস্তুহারা।
আমিনা, আসমা, সখিনার আর মোহাম্মদ আলীর মতো বাঁধের ঢালে এমন মানবেতর জীবযাপন করছে ৫০টিরও বেশি পরিবার। এছাড়া ভাড়া বাড়ি কিংবা অন্যের জমি ভাড়া নিয়েও বসবাস করছে অনেক পরিবার।
কথা হয় গিয়াস সরকার, টিয়া খাতুন, শফিকুল ইসলাম, হারুন ব্যাপারী, আলেয়া, মোহাম্মদ আলী, লাল্টু শেখ, শাহিনুর খাতুন, জীবন্নেছা, জয়গন, ইকবাল হোসেন, নুরুল ইসলাম মণ্ডল, জিল্লুর রহমান, কদবানু, জমেলা, আনোয়ারা, রতনা খাতুন, বুদ্ধ মিয়া, লক্ষ্মী খাতুনসহ ভূমিহীনদের সঙ্গে।
তারা জানান, যুগের পর যুগ ধরে এ অঞ্চলে যমুনার ভাঙন চললেও বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। তিন/চার বছর আগে সরকার একটি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প দিলেও ঠিকাদারদের গাফিলতির কারণে কাজ এগোচ্ছে না। এ কারণে গত পাঁচ বছরে শত শত মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়েছেন। কখনো বাঁধের ঢালে আবার কখনো অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে ঝুপড়ি ঘর তুলে কষ্টে জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।
বাস্তুহারা এসব মানুষের দাবি, পায়ের তলায় একটু মাটি আর মাথার ওপরে একটি চাল। যাতে পরিবার পরিজন নিয়ে দিনমজুরি করে সংসারটা চালাতে পারেন। কোনো ত্রাণ বা সাহায্য চান না তারা।
কলেজশিক্ষার্থী ইয়াছিন সরকার চতুর বলেন, বাঁধ নির্মাণকাজে দুর্নীতি হওয়ায় আমাদের বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়েছে। আজ আমরা আশ্রয়হীন। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। রোদ-বৃষ্টির মধ্যে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি। সরকারে কাছে আমাদের মতো ভূমিহীনদের পুনর্বাসন করার দাবি জানাই।
শিক্ষক মো. শাহিন আলম বলেন, হাটপাচিল এলাকায় প্রায় সাড়ে তিনশর মত ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গিয়েছিল। অনেকের এক শতাংশ জায়গা কেনার অবস্থা নেই। সরকার যদি গুচ্ছগ্রাম করে তাদের ঠাঁই দেয়, তবেই তারা শান্তিতে থাকতে পারবেন।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, এখন তো আশ্রয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে কোনো বরাদ্দ নেই। পরে কি হবে এ রকম নির্দেশনাও নেই। আমরা তালিকা করে রেখেছি, বরাদ্দ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আমি ওই এলাকায় গিয়ে তাদের বলেছিলাম, খাস জায়গা বের করতে। আশেপাশে যদি খাস জায়গা থাকে, আমরা সেটা বরাদ্দ দেব।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৪
এসআই