চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে মহান বিজয় দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছুরিকাঘাতে এক কিশোরসহ দুজন নিহত হওয়ার ঘটনায় তাদের গ্রামে এখনও চলছে শোকের মাতম। স্থানীয়দের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ।
এদিকে এ ঘটনায় পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দল তাদের কাজ শুরু করেছে। এ ঘটনায় দু'জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এর আগে মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত পৌনে ১১টার দিকে নাচোল উপজেলার মল্লিকপুর বাজারে এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- নাচোল উপজেলার খোলসী গ্রামের এজাবুল হকের ছেলে মো. মাসুদ রানা (২০)। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী এবং একই প্রতিষ্ঠানের একই বিভাগের বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি।
অপরজন ফতেপুর এলাকার আব্দুর রহিমের ছেলে রায়হান আলী (১৪)।
এ ঘটনায় আহতরা হলেন- খোলসী গ্রামের আলমের ছেলে মো. রজব আলী রনি (১৪), ফিরোজ আলীর ছেলে মো. ইমন (১৫), জালাল উদ্দিনের ছেলে মো. সুমন (১৮) ও একই এলাকার মো. রব্বানী ওরফে পাতুর ছেলে. মো. আরমান (১৬)।
এদের মধ্যে রজব আলী ও সুমনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, প্রায় ১৫ দিন আগে একটি পেয়ারা বাগানে পেয়ারায় পলিব্যাগ লাগানোর কাজ করছিল নাচোল উপজেলার খোলসী গ্রামের সালাম ও মল্লিকপুর গ্রামের শাহিন। এ সময় শাহিন গোপনে সালামের একটি আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এরই জেরে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। পরে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসা হলেও ওই ঘটনার জেরে বিজয় দিবসের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে উভয় পক্ষ। এ সময় সালামের পক্ষ নেওয়া মাসুদ ও রায়হানকে শাহিনের লোকজন টেনে নিয়ে গিয়ে পাশের মাংসপট্টিতে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তারা নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয় আরও চারজন।
অন্যদিকে খোলসী গ্রামে গিয়ে দেখা যায় শোকের মাতম চলছে। এ ঘটনা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। একই গ্রামের দুইজনকে হত্যা এবং চারজনকে আহত করার জন্য পাশের মল্লিকপুর গ্রামকে দায়ী করছেন তারা। সবার দাবি যুবদল নেতা শাহিনের নেতৃত্বে একটি কিশোর গ্যাং পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
নিহত মাসুদ রানার দাদি তারাফুন বেগম জানান, একমাত্র শিক্ষিত মেধাবী নাতিকে যারা হত্যা করেছে তাদের একইভাবে সব্বোর্চ্চ শাস্তি হোক। মাসুদ মাদরাসা থেকে পাশ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পলিটেকনিকে ভর্তি হয়েছিল। স্বপ্ন দেখিয়েছিল সে একদিন মস্ত চাকুরে হবে। পরিবারের হাল ধরবে। এলাকাবাসীর সুখে-দুঃখে সবার বিপদে এগিয়ে যাওয়ায় এভাবে তাকে প্রাণ দিতে হলো।
ছোট ভাই মোস্তাকিম হোসেন জানান, তিন ভাই এক বোনের মধ্যে এক ভাই ঢাকায় কাজ করে ও সে এলাকায় গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাতেন। মেজ ভাই মাসুদকে বাপের যোগ্য সন্তান তৈরির জন্য সবার চেষ্টা ছিল কিন্তু সে স্বপ্ন সন্ত্রাসীরা কেড়ে নিল।
এলাকাবাসী মনিরুল ইসলাম জানান, নিহতদের দুজনই মাদরাসার মেধাবী ছাত্র এবং ব্যবহার ছিল মানবিক। ওরা কখনো তুই কথাটাও বলত না। অপরদিকে হত্যাকারী শাহিন কিশোর গ্যাং লিডার এবং কুখ্যাত জেলফেরত আসামি। খোলসির জনগণকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে মেধাবী দুই ছাত্রকে।
স্থানীয় রাকিবুল ক্ষোভের সঙ্গে জানান, সন্ত্রাসী শাহিনের ডিজে গ্রুপের কাজ হলো মিউজিকের তালে তালে হাঙ্গামা করা। এর আগেও একইভাবে তারা একটি তেলের পাম্পে হামলা করেছে। ২০/২৫ জনের এ দলটি পরিকল্পনা করে আগের রাগ তুলতে অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে পরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা করেছে। তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করেন স্থানীয় এ ব্যক্তি।
স্থানীয়রা ও পরিবারের সদস্যদের দাবি মাসুদ কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। তবে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সে ছাত্রলীগের তার ডিপার্টমেন্টের সভাপতি ছিলেন।
এদিকে অপর নিহত কিশোর রায়হানের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তার নিষ্পাপ সন্তানের হত্যার বিচার এ দুনিয়ায় পাবেন না। তাই তিনি বিচার চান না। আল্লাহর কাছে এ হত্যার বিচার চান।
রায়হানের ভাই আব্দুল আজিম জানান, ১৩ বছর বয়সী ছোট ভাইকে তারা রাজনৈতিক কারণে বা স্থানীয় বিরোধের জেরে হত্যা করেছে। খোলসী গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় এবং নিহত মাসুদ রানা ছাত্রলীগ নেতা হওয়ায় তাদের সঙ্গে থাকার কারণে তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে।
আহত মো. রজব আলী রনি জানান, মল্লিকপুর গরুর হাটে শহীদ জিয়া সংঘের উদ্যোগে আলোচনা সভা, পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল এ সময় স্থানীয় একই বয়সী কিছু ছেলে খোলসী গ্রামের লোকজনকে মারছে শুনতে পেয়ে তারা তাদের প্রতিরোধ করতে যায় এবং প্রতিপক্ষরা মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে গরুর হাট সংলগ্ন মাছ ও মাংস বিক্রয়ের ঘরে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। এ সময় প্রতিপক্ষরা নেশা জাতীয় কিছু তরল মুখে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত লোকজন আহতদের উদ্ধার করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় মাইক্রোবাসে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে আহত মাসুদ ও রায়হান মারা যায়।
নিহত মাসুদ ও রায়হানের পরিবার জানায়, কি কারণে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। তবে তারা তাদের সন্তানদের হত্যার বিচার দাবি করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. ফাহাদ আকিদ রেহমান জানান, আহত ও নিহত সবাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপানো হয়। তাদের ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাত করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে মল্লিকপুর এলাকার নিজ নিজ বাড়ি থেকে বাহার আলী মণ্ডলের ছেলে আজিজুল হক ও এজাবুল হকের ছেলে মো. তাসিম নামক দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪
আরএ