তারা বন্ধুদেরও সেরা বন্ধু। সাহায্যকারীদের মাঝেও সেরা সাহায্যকারী।
এই মিত্ররা এসেছেন বাংলাদেশে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর উদযাপনের আনন্দ ভাগাভাগি করতে এবার এসেছেন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সেইসব মুখগুলো যারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের হয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন ১৯৭১ সালে।
তাদের নিয়ে একটি অনন্য অয়োজন ছিল ঢাকায়। মিডিয়া ইন্টারঅ্যাকশনের এই আয়োজনে সাংবাদিকদের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা তুলে ধরেন তাদের গল্প। যার আয়োজন করে যৌথভাবে একাত্তর টেলিভিশন ও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন।
রাজধানীর কুর্মিটোলায় আর্মি গল্ফ ক্লাবের পামভিউ রেস্তোরাঁ ব্যলকনি যে হয়ে উঠেছিল তাদের মিলনমেলা। ভারত থেকে যারা এসেছেন, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের যোদ্ধারা। তারা স্মৃতিচারণ করছিলেন। গল্প শোনাচ্ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প, সাহসিকতার গল্প। আর যে সাহসিকতার মধ্য দিয়ে একটি দেশ স্বাধীনতা পায় তার প্রতিটি গল্পই ছিল অনন্য। কোনোটি হয়ত আরও শোনা হয়েছে, কিন্তু মনে হচ্ছিল যেনো নতুন করে শোনা।
সবাই এখন অবসরপ্রাপ্ত। বয়সে প্রবীণ। কিন্তু প্রত্যেকের চোখেমুখেই যেনো একই দীপ্তি। যোদ্ধার চোখের দীপ্তি কখনোই মরে না। যোদ্ধার বয়সও কখনোই বাড়ে না, এমনটাই মনে হচ্ছিলো প্রত্যেককে দেখে।
কয়েক ডজন ভারতীয় সেনা এসেছিলেন। কেউ কেউ তাদের পরিবার পরিজনকেও নিয়ে এসেছেন। ফলে এক আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয় সেখানে। আর ক্রমেই ঘনিয়ে উঠতে থাকে আবেগও। বিশেষ করে দুই সহযোদ্ধা, যারা একই বাংকার শেয়ার করেছিলেন, একই যুদ্ধক্ষেত্রে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় এই মিলন মেলায়।
আলোচনার সূত্রপাত করেন, একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু। তিনি বলেন, আমরা দুই দেশ মিলে সেদিন একটি যুদ্ধ করেছিলাম। আমাদের সম্পর্ক রক্ত দিয়ে লেখা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এমনই এক যুদ্ধ ছিল তার প্রতিটি গল্পই আলাদা। তাই এখানে যা কিছু আমরা শুনতে পাবো তা আলাদা কিছুই হবে।
সত্যি আলাদা আলাদা একেকটি অনন্য গল্প শোনালেন যোদ্ধারা। কেউ তাদের বীরত্বের গল্প, কেউ বা সহযোদ্ধার বীরত্বের গল্প। কেউ তুলে ধরলেন বাংলাদেশের মানুষের মানবিকতার গল্প।
জিপি ক্যাম্পেন হেমন্ত সারদেশাইর কথাই ধরুন না। তিনি ছিলেন ৪ নম্বর সেক্টরে। ভারতের গৌহাটি, আসাম এলাকা থেকে তিনি যুদ্ধে আসেন। বাংলাদেশে তার সেরা যুদ্ধ ছিল ঢাকার কুর্মিটোলায়। তার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল তেজগাঁও রেলওয়ের ওপর হামলা, গভর্নর হাউজে হামলা। তবে তাকে আজও যে স্মৃতি শিহরিত করে তা হচ্ছে, তিনি ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজির পলায়ন।
হেমন্ত সারদেশাই বলেন, রাতেই খবর এলো রেঙ্গুন থেকে একটি প্লেন এসে জেনারেল নিয়াজিকে নিয়ে যাবে। সেটি অবতরণ করবে তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়েতে। তার দায়িত্ব হলো নিয়াজি যাতে কোনোভাবেই পালাতে না পারেন। সে লক্ষ্যে দায়িত্ব নিয়ে হেমন্তের নেতৃত্বে সকাল থেকেই শুরু হয় বোমা হামলা। সেদিন জীবন বাজি রেখে জেনারেল নিয়াজির পলায়ন রোধ করেছিলেন তিনি।
লে. জেনারেল জি এস সিহোতা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে কোথায় নদী পার হতে গিয়ে মাঝির সাহসী সহযোগিতা পেয়েছিলেন, কোথায় গ্রামের ভেতরে সাধারণ মানুষ তাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন, কোথায় কে খাবার দিয়েছিলেন সেসব স্মৃতিও তুলে ধরেন। একজন গনক, একজন মাঝি, একজন গৃহস্থ কীভাবে তাদের সতর্ক করেছিলেন তা জানান সিহোতা। পাকিস্তানি বাহিনীর উপর্যুপরি বুলেটের মাঝেও হেলিকপ্টার নিয়ে কীভাবে নিরাপদে ফিরে আসেন সে কাহিনী শোনান।
অনুষ্ঠানে সবচেয়ে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় যখন দেখা হয়ে যায় সেই দুই যোদ্ধার যাদের একজন বাংলাদেশের অন্যজন ভারতীয়। অকুতোভয় এই দুই যোদ্ধা হলেন, বাংলাদেশের সাবেক সেনা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুন অর রশীদ বীরপ্রতীক এবং ভারতের সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল এম এম রবি। উঠে আসে কীভাবে সেদিন অস্ত্র দিয়ে সাহস যুগিয়েছিলেন বাংলাদেশের একদল মুক্তিযোদ্ধাকে।
ব্রিগেডিয়ার ভনত মদন মোহন বলেন, পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশে নিয়ে যেভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে সহায়তা করেছে- সেভাবেই আজীবন মিত্রবাহিনী হিসেবে পাশে থাকবে ভারত।
এসেছিলেন বাঙালি চিকিৎসক দীপক কুমার সেন। তিনি বসেছিলেন দর্শকদের মাঝে। অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে জানালেন মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিনগুলোতে তিনি শত শত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা করেছেন। খুলনা ও যশোর এলাকায় ঘুরে ঘুরে ক্যাম্প করে এসব যোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছিলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে যোদ্ধারা তুলে ধরেন বাংলাদেশের যুদ্ধজয়ের কীর্তি। আর একই সঙ্গে তারা প্রশংসা করেন বাংলাদেশের আজকের এগিয়ে চলার। প্রত্যেকের মুখেই ছিল একটি কথা বাংলাদেশ ভালো করছে, বাংলাদেশে এগিয়ে যাচ্ছে। যে দেশকে তারা জীবন বাজি রেখে স্বাধীন করতে ভূমিকা রেখেছিলেন সে দেশটির অগ্রগতি দেখে তারা আজ গর্বিত বলেই উল্লেখ করেন এ সময়।
আলোচনায় বার বার উঠে আসে বাংলাদেশের অনন্য মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের কথা। খালেদ মোশাররফের মেয়ে মাহজাবিন খালেদ ছিলেন দর্শক সারিতে। তিনি উঠে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বাবার সাহসিকতার গল্প শোনান। তবে বলেন, সেসময় তিনি ছিলেন ছোট। তাই বাবার সাহসিকতার গল্প শুনতে চান তার সহযোদ্ধাদেরই কাছে।
দুই দেশের সামরিক বাহিনীর যোদ্ধারাই কেবল নন, এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি জগতের যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তারাও।
বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। দর্শক সারি থেকে ডাকা হয় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল মোটেই ছয় বছর। আজ আমি এই মুক্তিযোদ্ধাদের কেবল স্যালুটই করতে পারি।
ভারত থেকে এসেছেন ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও ছয়জন সার্ভিং অফিসার। মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন লে. জেনারেল জি এস সিহোতা, লে. জেনারেল ভি এস টংক, মেজর জেনারেল দীপক কুমার সেন, মেজর জেনারেল হরিন্দর সিং বাত্রা, ব্রিগেডিয়ার ভনত মদন মোহন, ব্রিগেডিয়ার সতিন্দর মালরাজ চান্দ, ব্রিগেডিয়ার নরেন্দ্র কুমার গুপ্ত, ব্রিগেডিয়ার তালওযার কিরন কুমার, ব্রিগেডিয়ার আশীষ দুবে, কর্নেল বিমল কিষান দাস, কর্নেল মহাবীর সিং, কর্নেল নরেন্দ্র সিং রাওয়াত, কর্নেল মহেন্দ্র মানদাপা রবি, লে. কর্নেল মহেষ চন্দ্র যোশি, লে. কর্নেল জে এস সারাই, লে. কর্নেল ডি ডি পাল সিং, লে. কর্নেল রবীন্দ্র সিং, লে কর্নেল সুরজিত সিং পালমার, লে. কর্নেল হর্ষ বর্ধন, মেজর সুরেন্দর কুমার মেহতা, মেজর বেলভি তেজবন্ত সিং, ক্যাপ্টেন রমাচন্দন দামোদরান পিল্লাই, ক্যাপ্টেন হিমকর বল্লভ পান্ডে, গ্রুপ ক্যাপ্টেন হেমন্ত সারদেশাই, এয়ার কমোডর চন্দ্র মোহন সিংলা।
সার্ভিস অফিসারদের মধ্যে ছিলেন, মেজর জেনারেল আর সিরোহি, মেজর ভরত শর্মা, কমোডর রাজেশ ধাংকার, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এইচপি নইর।
আরও পড়ুন:
***বাবা বলেছিলেন, আমি মেয়েদের খুঁজলে যুদ্ধ দেখবে কে
** লে. জেনারেল সিহোতা শোনালেন মানবতা ও সাহসিকতার গল্প (ভিডিও)
***হেমন্ত সারদেশাই ঠেকিয়ে দেন নিয়াজির পলায়ন
** বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধন রক্ত দিয়ে লেখা
** মুক্তিযুদ্ধের গল্প আসরে বাংলাদেশ-ভারতের যোদ্ধারা
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬
আইএ/এমএমকে