রাজশাহী: ‘দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ তখন চরমে। সবকটি রণাঙ্গনেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মার খেতে শুরু করেছে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ের অবস্থা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক তৈয়বুর রহমান।
তিনি বর্তমানে স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা সোনালী সংবাদে কর্মরত। তিনি জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের একেকটি দিন, একেকটি ক্ষণ আজও তার স্মৃতিপটে গেঁথে আছে। যা কখনও ভোলার নয়।
মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহীর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে কেবল মনের জোরেই যুদ্ধ করেছিলাম। আমাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল শত্রুপক্ষকে আতঙ্কগ্রস্ত করা। শত্রুপক্ষের শক্তিকে এক স্থানে কোনোভাবেই সুসংহত হতে না দেওয়া। বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। তবে নিজেদের ক্ষতি এড়িয়ে হানাদার বাহিনীর ক্ষতি করতে হবে। যুদ্ধে কৌশলটি খুবই কার্যকর হয়েছিলো এবং পাক হানাদার বাহিনীর মনোবল ভাঙতে শুরু করেছিলো। কিন্তু প্রয়োজনীয় অস্ত্রের অভাবে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছিলাম না। আমাদের কাছে যুদ্ধাস্ত্র বলতে ছিল থ্রি নট থ্রি, এসএলআর, এসএমজি, হ্যান্ড গ্রেনেড আর এক্সপ্লোসিভ (বিস্ফোরক)। তাও ছিল অপ্রতুল। আর পাক বাহিনী ছিল সব ধরনের আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত। বলা চলে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুধু মনের জোরে আমরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি অসম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলতে গিয়ে তৈয়বুর রহমান বলেন, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, মোহনপুর, পবা, তানোরসহ বেশ কিছু অঞ্চলের শত্রুপক্ষের বিভিন্ন আস্তানায় আক্রমণ চালাতে গিয়ে আর্মস অ্যামুনেশন শেষ হয়ে যায়। এ সময় আমাদের এফএফ যুদ্ধকালীন কমান্ডার শফিকুর রহমান রাজা আর্মস অ্যামুনেশন আনার জন্য সরাসরি হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য নির্দেশ দেন তাকে।
নির্দেশ পাওয়া মাত্র হেড কোয়ার্টারে গিয়ে সাব সেক্টর কমান্ডার ৪-এর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে রিপোর্ট করার পর প্রয়োজনীয় গোলা-বারুদ দেওয়ার কথা বললাম। সাব-সেক্টর দফতরের বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এরই মধ্যে ডিফেন্সের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে সম্মুখ যুদ্ধের পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যেই আনন্দে বুকটা ভরে উঠলো।
তখনই হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমি সম্মুখ যুদ্ধে আংশ নেবো। যদিও সম্মুখ যুদ্ধে ট্রেনিং আমার অল্প ছিল। সাব সেক্টরের অধিনায়ক তৎকালীন মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে আমার এ অভিপ্রায়ের কথা জানালাম। তিনি আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ঠিক আছে অপেক্ষা করো। এর কদিন পরেই আমাকে ফরিদপুরের মুক্তাঞ্চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।
ফরিদপুর রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানা থেকে সোজা পশ্চিমে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ থানার (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা) দক্ষিণাঞ্চলের ভারতীয় সীমান্ত এলাকার পদ্মানদীর ধারের একটি মুক্তাঞ্চল। সেখানে আগে থেকেই প্রাক্তন ইপিআর ক্যাম্প ছিল। পরে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলা হয়। আমার হাতে যখন অ্যাডভান্স হওয়ার নির্দেশ এসে পৌঁছে তখন বিকেল ৪টা বাজে।
নির্দেশ পাওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য মনটা মুষড়ে পড়লো আমার। আমি মূল এফএফ দল থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ছি এজন্য। পরক্ষণে তা কেটে গেল। আমি যেন সম্মুখ যুদ্ধের রোমাঞ্চ অনুভব করতে লাগলাম। প্রস্তুতি নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওয়ানা দেওয়ার জন্য নৌকায় গিয়ে উঠতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়।
পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে নৌকা পাড়ে গিয়ে ভিড়লো। মাটিতে পা দিতে না দিতেই বাতাসে তীব্র শীষ দিয়ে ভেসে আসলো গুলির আওয়াজ। এ সম্পর্কে প্রশ্ন করায় ঘাটে অপেক্ষামাণ এক সহযোদ্ধা জানালেন পাকিস্তানি গুপ্তচর ধরা পড়েছে কয়েক দিন আগে। ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো, তারই শব্দ।
ফরিদপুর ক্যাম্প যখন পৌঁছলাম, তখন রাত ৯টা। ফরিদপুর ক্যাম্প থেকে কিছু দূরেই মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স। আমাকে নূর হামীম রিজভীর (বীর প্রতীক) গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। সেই ডিফেন্স থেকেই সম্মুখ যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের ধারা রচনা করেছিলাম আমি।
সহযোদ্ধাদের শহীদ হতে দেখেছি। তাদের বিয়োগ ব্যথায় মুষড়ে পড়েছি। কিন্তু শোককে শক্তি বানিয়ে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে দিনের পর দিন যুদ্ধ করে গেছি। তাদের মত দেশের জন্য শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে মৃত্যুর পরোয়ানা না করে শত্রুপক্ষের সঙ্গে আপ্রাণ লড়াই করে গেছি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমান আরও বলেন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। তাই বাংলার মাটিতে তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তাদের বাঁচাতে এখনও নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাই দ্রুত বিচার শেষ করতে হবে। সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দেখে যেতে পারলে মরেও শান্তি পাবো।
বাংলাদেশ সময়: ০২২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
এসএস/টিআই