কটিয়াদীর কুঁড়েরপাড় ঘুরে এসে (কিশোরগঞ্জ): হাতে বন্দুক, কোমরে বাঁধা গামছা তাতে রাখা কার্তুজ আর মাথায় টুপি। দেশ জয়ের শপথের এমন প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধ করতে এখুনি ছুটে যাবে এমনিভাব তিন মুক্তিসেনার।
লাল সবুজের পতাকা টাঙিয়ে আরেক সেনা অস্ত্র হাতে ওয়াচ টাওয়ারে (মুক্তবাংলা) দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছে নিজ মাতৃভূমি প্রিয় স্বদেশকে রক্ষায়। ওয়াচ টাওয়ারের ভেতর থেকে তাক করা আছে আরো কয়েকটি বন্দুক।
চারিধারে সবুজ প্রকৃতি ঠাসা এই স্থাপনার নাম “মরুদ্বীপ-৭১ স্বাধীনতা পার্ক”। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূর্ত প্রতীক। নিভৃত এক গাঁয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে পার্কটি।
কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুড়ি ইউনিয়নের নিভৃত কুঁড়েরপাড় গ্রামে গড়ে ওঠা এ পার্কটি যেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী সাক্ষ্য দিচ্ছে। ব্যতিক্রমী এ পার্ক ঘিরে এখন মানুষের আনাগোনা বাড়ছে নিভৃত এই কুঁড়েরপাড় গ্রামে।
এ গ্রামের সন্তান ও ঢাকা জজ কোর্টের সহকারী সরকারি কৌসুলি (এপিপি) অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান ইকবাল। তিনি উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে নিজ পৈত্রিক ভিটার ১০ একর জমিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়ে দেশের প্রথম এ স্বাধীনতা পার্ক গড়ে তুলছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতি বিজড়িত এ পার্কের নামকরণ করা হয়েছে “মরুদ্বীপ ৭১ স্বাধীনতা র্পাক”।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পার্কের প্রবেশ পথে দেশের খ্যাতিমান ভাস্কর মৃণাল হকের তৈরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। এ প্রতিকৃতি পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই ডান পাশে দেখা যাবে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের স্মরণে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ দুর্বার। এখানেই চোখে পড়বে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। গাছের গায়ে লেখা রয়েছে কোন দেশের গাছ এবং গাছের নাম।
এসব গাছের সমারোহের নিচে ও রাস্তার ডান পাশে তৈরি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। আর ডান দিকে রয়েছে বিজয় সেতু নামে একটি সেতু। এ সেতু উৎসর্গ করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যাফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের নামে। সেতুটির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই চোখে পড়বে দর্শনার্থীদের জন্য মুক্তবাংলা নামে একটি বিশ্রামাগার। আর সেতুটিতে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন মুক্তিসেনা ও মুক্তবাংলা ঘরে উপরে অস্ত্র হাতে আরেক মুক্তিসেনা এবং বাংলার লাল সবুজের পতাকা। সেতুর নিচে রয়েছে বিশাল আকৃতির একটি পুকুর। পুকুরে শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে ছোট ছোট নৌকা ও প্যাডেল বোট।
পার্কের পশ্চিম পাশে অন্য একটি পুকুর পাড়ে রয়েছে (নির্মাণাধীন) মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চার নেতার প্রতিকৃতি। আবার এ পুকুরের মধ্যে বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তুলে ধরতে তৈরি করা হয়েছে ‘উৎসব দ্বীপ’ নামে একটি বিশ্রামাগার। একটি বাঁশের সাঁকোর উপর দিয়ে এ দ্বীপে যেতে হয়। এ দ্বীপের প্রবেশদ্বারের ডান পাশে তৈরি মৎস্যকন্যা, বক ও পেঙ্গুইনের ভাস্কর্য এবং বাম পাশেও রয়েছে একই ভাস্কর্যসহ প্রাণ ও প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্য।
এছাড়াও রয়েছে দু’দিকে দু’টি ছোট ছোট ধবল বক। সব মিলিয়ে ‘মরুদ্বীপ-৭১ স্বাধীনতা পার্ক’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও আবহমান বাংলার সংস্কৃতি আর বাংলা নিসর্গের মায়ারূপ।
২০১০ সালের ৩০ মার্চ প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী ‘মরুদ্বীপের-৭১ স্বাধীনতা পার্ক’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
কিশোরগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আসাদ উল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, অজপাড়াগাঁয়ে এটি একটি মহতি উদ্যোগ। আমাদের নতুন প্রজন্ম এ পার্কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।
পার্কের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান ইকবাল বাংলানিউজকে বলেন, আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও বাংলার বিলুপ্ত হওয়া ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তুলে ধরার উদ্দেশেই এ স্বাধীনতা পার্কটি গড়ে তোলা হচ্ছে। এ পার্কে এসে আগামী প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস-ঐহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে ও দেখতে পারে।
তিনি আরও জানান, দুই একর জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের সময়ের প্রতিকৃতি। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে জাদুঘর তৈরি করা হবে এবং তথ্য চিত্র ও ভিডিও চিত্র সংগ্রহ করে একটি ডিজিটাল জাদুঘর তৈরি করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬
আরএ