ঢাকা: বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে বাধা দেওয়া বা এ নিয়ে সৃষ্ট যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার কোমল-কঠোর কৌশল অবলম্বন করেছে। এ নিয়ে কোনো ধরনের সংঘাত যেন সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে সরকার যেমন সজাগ তেমনি ভাস্কর্য নির্মাণের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানও লক্ষ্য করা গেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যে।
জানা গেছে, যে কোনো পরিস্থিতি প্রশাসনিক ও আইনিভাবে মোকাবিলার কৌশল নিয়েছে সরকার। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকেও প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকারে থেকে সব বিষয়ে মাথা গরম করলে চলবে না। তাই তার দল ভাস্কর্য ইস্যুতে সরাসরি কোনো সংঘাতে যেতে চায় না। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ‘হ্যান্ডেল’ করছেন বলেও তিনি জানান।
বিষয়টি সমাধানের ব্যাপারে সরকারের এক ধরনের কোমল প্রক্রিয়াও যে আছে তা কিছুটা স্পষ্ট করেছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। জামালপুরে এক অনুষ্ঠানে শনিবার তিনি বলেন, “ভাস্কর্যের ব্যাপারে আলোচনা চলছে, এক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে সমাধান হবে। সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন রেখে বাংলাদেশ কোনো কাজ করে না। অসাম্প্রদায়িকতার বাংলাদেশের জন্য যা করা দরকার, সেটি নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ”
এদিকে ভাস্কর্য ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে চলমান সংকট নিরসনে নিজেদের দাবি ও অবস্থান তুলে ধরার কথা বলেছেন আলেমরা। তারা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি তুলে ধরতে প্রধানমন্ত্রীকে শরিয়তসম্মত কিছু প্রস্তাব দিতে চান বলেও জানিয়েছেন।
সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে এক বিন্দুও সরে আসবেন না তারা। শুধু তাই নয়, বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেবেন না তারা। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরির সিদ্ধান্তের সঙ্গে এ বিষয়গুলো প্রবলভাবে জড়িয়ে আছে।
২০১৭ সালে হেফাজতে ইসলামের দাবিতে সুপ্রিস কোর্ট চত্বরে স্থাপিত গ্রিক দেবি থেমিসের ভাস্কর্য সরিয়ে নেয় সরকার। তখন বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও সংগঠন থেমিসের ভাস্কর্য সরানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তারপরও ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়া হয়।
তবে সরকার ও আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। কোনো গোষ্ঠীর হুমকির কাছে সরকার নতি স্বীকার করবে না।
ওই নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে আরও জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরির ইস্যুতে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে যারা আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী তাদের আর মাঠে নামতে দেবে না। ইতোমধ্যেই ঢাকা শহরে অনুমতি ছাড়া সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
শুক্রবার (৪ ডিসেম্বর) বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে এ ইস্যুতে মুসল্লিরা মিছিল বের করলে পুলিশ বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী আরও কঠোর অবস্থানে যাবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
এদিকে যেসব সংগঠন আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য মাঠে নামার চেষ্টা করছে, সেসব সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা কঠোর নজরদারিতে রয়েছে। ভাস্কর্যকে ইস্যু করে ধ্বংসাত্মক কোনো তৎপরতার চেষ্টা করলে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
তবে এরইমধ্যে ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির ফয়জুল করিমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার ঘোষণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।
প্রশাসনের পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠনও এদের বিরুদ্ধে সরব। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন, ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন সোচ্চার রয়েছে। করোনা ভাইরাস জনিত কারণে মাঠের তৎপরতা ব্যাপকভাবে সম্ভব না হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও সব অসাম্প্রদায়িক সংগঠনকে রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুত রাখা হবে বলে জানা যায়।
ঢাকার যাত্রাবাড়ীর হানিফ ফ্লাইওভারের শেষে ধোলাইপাড় মোড়ে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বঙ্গবন্ধুর এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হচ্ছে। চীন থেকে তৈরি করে আনা ভাস্কর্যটি সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে। এ ভাস্কর্য তৈরি নিয়ে নভেম্বর মাঝামাঝি থেকে সরাসরি বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, “অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জনগণ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। এ ইস্যুতে যে কোনো বিশৃঙ্খলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ও প্রশাসন কঠোরভাবে প্রতিহত করবে। ”
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতি বিরোধী শক্তির সঙ্গে কোনো আপস নেই। বাংলাদেশে থাকতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে হবে। অন্য কোনো সুযোগ নেই। জাতির পিতার ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে, এর জন্য যা যা দরকার সব প্রক্রিয়াই অবলম্বন করা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী এখন অনেক শক্তিশালী। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তাদের কঠিন পরিণাম ভোগ করতে হবে। ”
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলানিউজকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে রেহাই পাবে না। এর বিরুদ্ধে জনগণ রুখে দাঁড়াবে। বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খরা রক্ষাবাহিনী আইন অনুযায়ী কঠোর পদক্ষেপ নেবে। ”
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০২০
এসকে/এফএম/এজে