ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

যেসব বিষয়ে বড় পরিবর্তনের কথা ভাবছে সংস্কার কমিশনগুলো

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২৪
যেসব বিষয়ে বড় পরিবর্তনের কথা ভাবছে সংস্কার কমিশনগুলো

অন্তর্বর্তী সরকার এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে দিয়েছে। এসব কমিশন বেশ কিছু নতুন প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করেছে।

এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কারে বড়সড় পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে কমিশনগুলো।

এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র সংস্কারে মোট দশটি কমিশন গঠন করা হলেও এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সংবিধান ও নির্বাচনী সংস্কারের বিষয়গুলো।

কী পরিবর্তন আসতে পারে সংবিধানে?

অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে অংশীজনসহ অনেকের সাথে বৈঠক করেছে।

সংস্কার কমিশনের সাথে বৈঠকে বসে কেউ কেউ বলেছেন বর্তমানে বাংলাদেশের যে সংবিধান রয়েছে, সেটি যে কোন সরকারকে স্বৈরাচারী করে তুলতে পারে। যে কারণে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নানা সংস্কার প্রস্তাবও এসেছে।

সংস্কার কমিশন এরইমধ্যে যেসব পরামর্শ পেয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু, সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালু, আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু।

প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা কমানোসহ একজন ব্যক্তিকে দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না রাখার বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করতেও পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের পরামর্শও দিয়েছে অংশীজনদের কেউ কেউ।

সংসদেসংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানো কমানো নিয়ে দুই ধরনের পরামর্শই এসেছে কারো কারো কাছ থেকে।

সংবিধান সংস্কার কমিটির প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পরামর্শগুলো আমরা লিপিবদ্ধ করছি। যে যে বিষয়গুলোতে এখন পর্যন্ত ঐকমত্য আছে সেগুলোও নোটডাউন করছি।

এদিকে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে বর্তমানে সংসদ কার্যকর নেই। যে কারণে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো কীভাবে অনুমোদন করা যায়, তা নিয়েও নানা মতামত আসছে।

অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সংসদের বাইরে সংবিধান পরিবর্তনের বিরুদ্ধে। একই ধরনের মতামত এসেছে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও।

কমিশন প্রধান অধ্যাপক রীয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা আপাতত সাতটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। এখানে কী হবে সেটা আমরা চূড়ান্ত করতে পারব। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় হবে সেটি আমরা এখনই বলতে পারব না।

খোঁজা হচ্ছে টেকসই নির্বাচন ব্যবস্থার পথ

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন ও বেশিরভাগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে দেশে নির্বাচন নিয়ে এমন অনাস্থা-সংকট ও স্বৈরাচারী প্রথা গড়ে উঠেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

যে কারণে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করতে দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ খুঁজছে কমিশন।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, বলা হয়ে থাকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ভোটের সময় সরকার যদি ইসির কথা না শোনে, তা নিয়ে কিছু বলা নেই সংবিধান কিংবা আইনে।

এ সংস্কার কমিশন জানাচ্ছে, প্রস্তাবে তারা নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা, সীমানা নির্ধারণ আইনে পরিবর্তনের প্রস্তাব করার বিষয়েও একমত হয়েছে।

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার জানান, নির্বাচনে স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রস্তুত, রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনী অপরাধ বন্ধে আইনে সংস্কারের মতো বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে কীভাবে স্বাধীন করা যায়, কিংবা জনগণের কাছে ইসির দায়বদ্ধতা নিয়েও আমরা আলোচনা করছি।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে মতামত নিতে এরই মধ্যে ২২টি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে সংস্কার কমিশন। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সবার মতামতের ভিত্তিতে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা আমাদের চূড়ান্ত প্রস্তাবনা সরকারের কাছে পাঠাব।

পুলিশ সংস্কারের যেসব প্রস্তাবনা

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে পুলিশের নানা কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের কাছে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিষয়টিকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের পুলিশি কাঠামো ঢেলে সাজানোর কথা বলছে।

আইনি কাঠামো সংস্কার, পুলিশের জবাবদিহিতা, পেশাদারি দক্ষতা বাড়ানো, জনকল্যাণমূলক কাজে পুলিশের অংশগ্রহণ বাড়ানো, পুলিশের অপকর্ম রোধে নানা প্রস্তাবনাও এসেছে।

সোমবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক শেষে পুলিশ সংস্কার কমিশন জানিয়েছে বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় দেখার কারণে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়।

এ কারণে আগামীতে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় না দেখার সুপারিশ করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সরফ রাজ হোসেন।

হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে পুলিশ গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিতে পারবে সংস্কার প্রস্তাবে এমন সুপারিশও করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিশন প্রধান।

এ সংস্কার কমিশন বলছে, বর্তমানে পুলিশ চলছে প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো আইন দিয়ে। পুলিশ সংস্কারে নানা প্রস্তাবনার পাশাপাশি পুলিশ আইন সংস্কারেরও সুপারিশ দেবে কমিশন।

কী পরিবর্তন আসতে  জনপ্রশাসনে?

বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণ নিয়ে নানা মহলে প্রশ্নও উঠেছে।  

অনেক সময় সরকারি আমলাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা পক্ষপাতিত্ব নিয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও সেগুলো বন্ধে কঠোর কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।

গণঅভ্যুত্থানের পর গত তিন মাসেও মৌলিক কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় নি জনপ্রশাসনে।

গত অক্টোবরে সাবেক আমলা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।

এ কমিশন এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। মতামত নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অংশীজন, জনপ্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছে এ কমিশন।

এক্ষেত্রে অনেকে জনপ্রশাসনে দুর্নীতি বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া, সরকারি চাকরিতে নিয়োগে স্বচ্ছতা, প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণে উদ্যোগ, বদলি কিংবা পদায়নে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মানার মতো বিষয়গুলোও উঠে এসেছে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য মেহেদী হাসান বলেন, প্রশাসনে কাঠামোগত জায়গা থেকে একটি এবং জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলতে আরেকটি, এ দুই সংস্কার সবচেয়ে বেশি জরুরি। কমিশন সব মতামতকে আমলে নিয়ে কাজ করছে।

কমিশন সদস্যরা বলছেন, রাজনীতিবিদদের অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার এক ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সেটি বন্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়েও ভাবছে সংস্কার কমিশন।

সংস্কার ও সমন্বয়

কমিশনগুলো সংস্কার প্রস্তাব দিলেও যে চূড়ান্তভাবে সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

কেননা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করার পর তা নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আবার বৈঠকে বসার ঘোষণা দিয়েছেন সরকার প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতা না হলেও অনেক সুপারিশই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয় যেমন আছে। তেমনি কিন্তু সাধারণ মানুষের মতামতের বিষয়ও আছে। আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বেশি সংখ্যক মানুষের মত।

সংস্কার প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করে নির্বাচন কবে হবে, সেই প্রশ্ন বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এরইমধ্যে আসতে শুরু করেছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার শেষেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের পথে হাঁটতে চায় তারা।

বিবিসি বাংলা অবলম্বনে

বাংলাদেশ সময়: ১১১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২৪
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।