কিছু কিছু দুঃখ থাকে কাউকে বলা যায় না, কারও সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। নিজের ভিতরের রক্তক্ষরণ নিয়েই কাটিয়ে দিতে হয় একটি জীবন।
এ জগতে রহস্যের শেষ নেই। মানুষের বেঁচে থাকাও এক রহস্য। মৃত্যুকে অনেকবার নিজেও কাছ থেকে দেখেছি। করোনা হয়েছিল শুরুর দিকে। দেশ-বিদেশে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়েছি বারবার। মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে সবকিছু বড্ড বেশি ক্ষণস্থায়ী। মানুষ চলে গেলে আর কিছু থাকে না। সবকিছু শেষ হয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায়। যাওয়ার সময় কিছুই নিয়ে যায় না। কেউ সঙ্গে যায় না। জানাজায় আসারও সময় থাকে না অনেক প্রিয়জনের। আবার অনেকে দাফন, জানাজায় এসেও ব্যস্ত থাকে নিজেদের পরবর্তী আড্ডা কিংবা দুনিয়াদারির আলোচনায়। গল্পগুজব হয় দাফনে অংশগ্রহণকারীদের। আড্ডাও হয়। জগৎ সংসার নিয়ে কথার শেষ নেই। মৃত ব্যক্তিকে ঘিরে শোকের সময় কোথায়? এ সময়ে নাজিম হিকমতের কবিতার মতো শোকের কোনো আয়ু থাকে না। মানুষ ব্যস্ত স্বাভাবিক জীবন নিয়ে। কে গেল কে থাকল তাতে কী যায় আসে? জগৎ সংসারেও শান্তি নেই। হাসপাতালে বসেও চিন্তা থাকে অন্যের ক্ষতি নিয়ে। যেন হানাহানি-সংঘাতে জড়িয়ে থাকাটাই বড় কাজ। কেউ বোঝে না ঠুনকো এ জীবন। জন্মের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে মৃত্যু শব্দটি। এ বাস্তবতা পাশ কাটানো যায় না। সময় হলেই চলে যেতে হয়। করোনা প্রমাণ করে দিয়েছে, চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে বড়াইয়ের কিছু নেই। পুরনো একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ’৯২ সালের শুরুর দিকে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে যাচ্ছিলাম ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল মান্নান ভাইকে নিয়ে। তিনি তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সহপ্রচার সম্পাদক। পরে প্রচার ও সাংগঠনিক সম্পাদক হন। বিশ্বরোড পার হয়ে লাকসাম সড়কে আমরা। কিছু দূর যেতেই গাড়ির ব্রেক ফেল। গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে যায় গাড়িটি। সামান্য আহত হলাম আমরা। গাছের সঙ্গে ধাক্কা না খেলে পড়তাম পানিতে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শাজাহান মজুমদারসহ আমরা কোনোভাবে গাড়ি থেকে বের হলাম। মান্নান ভাই বিষণœ চোখে তাকালেন আমার দিকে। চোখে-মুখে মৃত্যুভয় সবার। কেউ কথা বাড়ালাম না। প্রাণ ফিরে পেয়ে তিনি শুধু বললেন, চল, একটা বেবিট্যাক্সি নাও। সভাটা শেষ করে ঢাকা ফিরে যেতে হবে। সেই মান্নান ভাই করোনাকালে কিছু দিন আগে চলে গেলেন। জীবন পেয়েছিলেন কুমিল্লায়। কিন্তু কোনো স্থায়িত্ব ছিল না।
আরেকবার ২০০১ সালে ব্রাসেলস থেকে লন্ডন ফিরছিলাম গাড়িতে। গাড়ি চালাচ্ছিলেন লন্ডনের কয়েস ভাই। আর ভিতরে বসা সিলেটের মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, অবজারভারের আশরাফ ভাই ও ক্যামেরাম্যান পল্লব। ব্রাসেলস থেকে আমরা রাতে আমস্টারডামে লেট ডিনার খেয়ে যাত্রা করি। ফেরিতে উঠে কয়েস ভাইকে বললাম, একটু ঘুুমিয়ে নিন। তিনি ঘুমালেন না। ভীষণ আমুদে মানুষ। গল্পগুজব আড্ডা পছন্দ করেন। দুনিয়া কাঁপিয়ে হাসেন। ঘুমচোখে হাইওয়েতে গাড়ি চলাচ্ছেন কয়েস ভাই। সামনে বসা সিরাজ ভাই। আমরা তিনজন পেছনে। হঠাৎ গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারালেন কয়েস ভাই। আমাদের পেছনে থাকা গাড়ির চালক দেখতে পাচ্ছিলেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। সতর্ক হলেন। কিন্তু হাইওয়ে বলে কথা। চিৎকার করে উঠলাম সবাই। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলেন কয়েস ভাই। কিন্তু ততক্ষণে আমাদেরটাসহ শতাধিক গাড়ি তছনছ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। আর জীবন ফিরে পেয়ে হাসতে থাকলেন কয়েস ভাই। আশরাফ ভাই সিনিয়র মানুষ। তিনি বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারছিলেন না। বিস্ময় নিয়ে কয়েস ভাইকে বললেন, আপনি কি মানুষ? এত বড় দুর্ঘটনার পরও হাসছেন! আমি কথা বাড়ালাম না। লন্ডন ফিরে এলাম। চলার পথে আরও অনেকবার মৃত্যুকে দেখেছি। ওয়ান-ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর মুক্তি দাবিতে নাঙ্গলকোটে একটি সভায় যোগ দিই। সন্ধ্যার পর এলাম কুমিল্লা শহরে। খাওয়া-দাওয়া শেষে ঢাকার পথে রওনা হই রাত ১১টায়। পথে শুনলাম আমাদের বন্ধু খলিল মারা গেছেন। সে রাত ছিল আকাশ ভেঙে পড়া জোছনা। চাঁদনি রাতে দূরের রাস্তায় এক ধরনের সৌন্দর্য থাকে। গাড়িতে ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সলিমউল্লা মিয়াজি বাচ্চু ও শহীদুল ইসলাম পাটোয়ারী। দাউদকান্দি ব্রিজ মেরামতের কাজ চলছিল সে সময়। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঘুরে ঢাকা ফিরতে হচ্ছিল আমাদের। মৃত বন্ধুর কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল করলাম সামনের বিশাল ট্রেইলার থেকে বড় ইস্পাতের পাত ছিটকে পড়ছে সড়কে। চালক ব্রেক কষলেন। পেছনে গাড়ি ছিল না। বেঁচে গেলাম। কিন্তু ভোররাতের দিকে টঙ্গীর কাছাকাছি আসতে ঘুমের ঘোরে ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ হারালেন। চিৎকার করে উঠলাম। চিৎকারে কাজ হয়। চালক আবার সড়কে ফিরে আসেন। সেদিনও চলে যেতে পারতাম। যাইনি। বেঁচে আছি। শুকরিয়া আদায় করি। দুনিয়ায় বেঁচে থাকার চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু না।
এক বন্ধু বললেন, আপনার আজকালের লেখায় মৃত্যু ভাবনা পাই। করোনার কারণেই কি এমন হচ্ছে? কী জবাব দেব বুঝতে পারি না। চারপাশের অনেক কিছুই ভালো লাগে না। দুই দিনের এ দুনিয়া। ক্ষমতা আরও বেশি ক্ষণস্থায়ী। আজকের ক্ষমতা কাল নাও থাকতে পারে। সব সরকারের আমলে অনেক ক্ষমতাবান মানুষ নাজিল হয়। তারপর একদিন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। হারিছ চৌধুরীর কথা কারও কি মনে আছে? সীমাহীন ক্ষমতার মালিক ছিলেন। দাপটের শেষ ছিল না। দিনকে রাত বলতেন, রাতকে দিন। সেই হারিছ চৌধুরী কোথায় আছেন কেউ জানে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাকে খুঁজছে। অনেক মামলার আসামি। ক্ষমতায় থাকাকালে সীমাহীন ঔদ্ধত্য দেখাতেন। নিজেকে পরিণত করেন এক রহস্যমানবে। ক্ষমতা হারানোর পরই পালিয়ে যান। ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে চমকে ওঠে। মাফিয়াসম্রাট দাউদ ইব্রাহিমের মতোই ছিল তাঁর কর্মকান্ড! দাউদ মুম্বাইয়ের অপরাধজগতের সম্রাট ছিলেন। হারিছ চৌধুরী অপকর্ম করতে বেছে নেন গোটা বাংলাদেশকে। ওয়ান-ইলেভেনের রাতেই পালিয়ে যান। দিনেরও অপেক্ষা করেননি। এখন কেউ বলছেন তিনি আছেন ভারতের করিমগঞ্জ। না, করিমগঞ্জে তাঁকে পায়নি কেউ। এরপর খবর রটে গেছেন ইরানে। আবার রটনা আসে তিনি আছেন লন্ডনে। ইন্টারপোল তাঁর হদিস বের করতে মাঠে নামে। পায়নি কোথায়ও। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, হয়তো তিনি পাকিস্তানে থাকতে পারেন। কারণ বঙ্গবন্ধুর একাধিক খুনি আছেন পাকিস্তানে। দাউদ ইব্রাহিমও পাকিস্তান। ওসামা বিন লাদেনও ধরা পড়ে খুন হন পাকিস্তানে। একুশে আগস্টের মাওলানা তাজউদ্দিনও পাকিস্তানে। হারিছ চৌধুরী পাকিস্তান থাকতে পারেন। কিন্তু পরিষ্কারভাবে কেউ কিছু বলতে পারছে না। অথচ বিএনপির শাসনকালে তাঁর দাপটের শেষ ছিল না। হাঁটাচলায় দম্ভ ছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সময় চুপসে যান। দেশ ছাড়েন। মইন উ আহমেদের সেনাসমর্থিত সরকার তন্ন তন্ন করে খুঁজে পায়নি। উলফাসহ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য চট্টগ্রামে ট্রাকে ট্রাকে অস্ত্র খালাস, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার, নাটোরের মমতাজ উদ্দিনসহ অনেক রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে তাঁর নাম উঠে আসে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভয়াবহ অপরাধে তাঁর জড়িতের প্রমাণ পেয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। রাজনীতির নামে তিনি যা খুশি করেছেন।
রাজনীতি খারাপ কিছু নয়। একসময় বিত্তশালী পরিবারের মানুষ রাজনীতিতে আসতেন। মানুষের সেবা করাই থাকত টার্গেট। ক্ষমতা আর লোভের রাজনীতি এখন সর্বনাশ করে দিয়েছে সবকিছুর। ক্ষমতায় থাকাকালে বাস্তবতা দেখতে পায় না কেউ। ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করতে পারে না। চেয়ার হারানোর পর টের পায় কত ধানে কত চাল! তখন কেউ পালিয়ে যায়। কেউ যায় কারাগারে। রাজনীতিতে ভালো-খারাপ দুটি অংশই আছে। অনেক রাজনীতিবিদ উজ্জ্বল আলোকরশ্মি নিভিয়ে দেন। আবার অনেকে অন্ধকারে আলো জ্বালান। ওয়ান-ইলেভেনের সময় লুৎফুজ্জামান বাবর একদিন পশ্চিমা কূটনীতিকদের ডেকে নেন তাঁর বাড়িতে। বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে গভীরভাবে বাবরের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ গল্প করতে দেখা গেল। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীও ছিলেন। কিন্তু আনোয়ার চৌধুরীর মনে একটা ক্ষত ছিল। সে ক্ষত সিলেটের মাজারে তাঁর ওপর বোমা হামলার। বাবর সাহেব তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। সেই হামলাকারীদের ঠিকভাবে আটকও করা হয়নি। মুখোমুখি করা হয়নি বিচারের। কূটনীতিকরা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। বাবরের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ছিল একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, পাশের দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য অস্ত্র আনা। বাবর ভাবতেই পারেননি সেসব ঘটনা নিয়ে একদিন জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু আল্লাহর চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান কেউ নয়। পশ্চিমা কূটনীতিকরা বাবরের বাড়িতে দাওয়াত খেলেন। জম্পেশ আড্ডা দিলেন। দুই দিন পরই আটক বাবর! আর শুরুতেই তাঁকে রিমান্ডে নিল র্যাব। অথচ এ র্যাব প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন অগ্রণী। ক্ষমতায় থাকাকালে র্যাব অফিসে গেলে স্যালুট পেতেন। ক্ষমতা হারানোর পর গেলেন কালো পট্টিতে চোখ বাঁধা, হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায়। সে ইতিহাস হয়তো অনেকের এখন আর মনে নেই। রাজনীতিবিদদের বড় সুবিধা তারা সব ভুলে যেতে পারেন। একজনের বিপদ দেখলে আরেকজন খুশি হন। একবারও ভাবেন না এ পরিণতি তারও হতে পারে। বাস্তব কারও পিছু ছাড়ে না। ভালো ও মন্দ কাজের বিচার দুনিয়াতেই সবাই এখন দেখে যায়। পরকালের অপেক্ষা করতে হয় না।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০২০