মৌলভীবাজার: এ যেন জীবনের এক ভিন্ন গল্প। গল্পের প্রধান চরিত্র সর্বোচ্চ হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে প্রত্যাশিত সোনার ফলস ঘরে তুলতে পারেন।
অন্য কৃষকরা যেখানে দিনে আট-দশ ঘণ্টা মাঠে কাজ করেন, সেখানে এই কৃষকের বিষয়টা একটু ভিন্ন। তিনি শুধু দিন নয়, রাতেও তার ফলসকে রক্ষার করার জন্য কাজ করেন। তা আবার এক-দু’দিন বা দু-চার দিনের জন্য নয়, দীর্ঘদিন ধরে।
তীব্র শীতের রাতে ফসল পাহারা দেওয়া রাতজাগা এই কৃষকের নাম সুমন মিয়া। বন্যশূকরের ক্ষতির হাত থেকে ফলসকে রক্ষা করতেই তার এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। ধানের সাথেই শীতের রাত্রীযাপন কৃষক সুমনের। তিনি থাকেন কমলগঞ্জ উপজেলার বাগবাড়ি এলাকায়। সম্প্রতি এই কৃষকের সাথে কথা হয় বাংলানিউজের।
সকালে নকশিকাঁথা মুড়ি দিয়ে রাতজাগা ক্লান্তির ঘুম কৃষকের চোখে। কাছে যেতেই ঘুম ভেঙে যায় তার। কৃষক সুমন মিয়া প্রথমেই এমন একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন, যে শব্দের অর্থ বুঝতে বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়। সিলেটি ভাষায় তার সেই প্রথম লাইনটি ছিল- “অনো ‘বনোরতা’ লামোইন। ” অর্থাৎ এখানে বনে যারা থাকে তারা নামে। কিছুক্ষণ পর বোঝা যায়, ‘বনোরতা’ মানে বন্যশূকরের কথা বলছেন তিনি।
সুমন জানান, ‘বনোরতা’ আমার সব ফসল নষ্ট করে দেয়। তাই নিজেই ধানগুলো রক্ষার জন্য পাহারা দেই। একটি-দুটি নয়, একসাথে ২০ থেকে ২৫টির দল নামে। দেখে ভয় লাগে তখন। টর্চ মেরে জোরে জোরে শব্দ করলে তারা পালিয়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টা/৮টার দিকে তারা নামে। আবার আসে মাঝরাতে। পুরো রাত জেগে ধান পাহারা না দিলে জমির সব ধান নষ্ট করে দিতে চায় তারা।
নিজের চাষাবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার প্রায় দশ কেয়ার (বিঘা) জমি আছে। এখানে আমন ধান, বিরুন (বিন্নি), বেগুনগুটি, লাল ধান লাগিয়েছি। আর কয়েকদিন পরেই কাটা হবে এগুলো। কিয়ার (বিঘা) প্রতি ১৫ থেকে ২০ মণ ধান হবার কথা।
সপ্তাহে এক হাজার টাকা মজুরিতে একসময় কৃষক সুমন মিয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শ্রীমঙ্গল-শেরপুর লাইনের গাড়িতে সুপারভাইজার পদে চাকরি করতেন। বেশি কষ্ট হয় বলে সে চাকরি ছেড়ে নিজে কৃষিকাজে নেমেছেন। আগে তার এ জমিগুলো লিজ দেওয়া ছিল। এখন নিজেই চাষ করছেন। এক বছর চাষ করে ভালো লাভ পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি। তিন মেয়ে এবং স্ত্রী নিয়ে কৃষক সুমনের ছোট্ট পরিবার। বড় মেয়ে এবং মেজ মেয়ে পড়ে ৪র্থ শ্রেণি এবং ১ম শ্রেণিতে। ছোট মেয়েটা ছোট। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে পাহারার জন্য জমিতে আসতে হয়। তারপর সারারাত ধান পাহারা দিয়ে সকাল ৭টার দিকে বাড়ি গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার ধান ক্ষেতে এসে ধানগাছগুলোর পরিচর্যা করতে হয়। দুপুরে বাড়ি ফিরে, খেয়ে, ঘুমিয়ে আবার পুনরায় সন্ধ্যায় ধান পাহারায় ফিরে আসতে হয় তাকে। এটাই এই রাতজাগা কৃষকের ছকবাধা জীবন।
দিনে অবশ্য বানরের দলও নামে। তখন অন্য মানুষ পাহারায় থাকে। তবে বানরের থেকে ‘বনোরতা’ বেশি ক্ষতিকর বলে জানান তিনি। এরা ফসল খাবার তুলনায় ফসল নষ্ট করে বেশি। আর এ ব্যাপারে সাহায্য পেলে সুবিধা হতো বলেও জানান সুমন।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের ফরেস্টের পাশের ধানক্ষেতেগুলোতে যদি কোনো কৃষক বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে ক্ষতির শিকার হয়ে থাকে, তবে উপযুক্ত প্রমাণসহ দরখাস্ত করলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০
বিবিবি/এইচএমএস