ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ১৯ ডিসেম্বর ঈশ্বরদী মুক্ত দিবস

টিপু সুলতান, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০২০
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ১৯ ডিসেম্বর ঈশ্বরদী মুক্ত দিবস মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ১৯ ডিসেম্বর ঈশ্বরদী মুক্ত দিবস। ছবি: বাংলানিউজ

পাবনা (ঈশ্বরদী): মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী সাত নম্বর সেক্টরের অধীনের ছিল। বাংলাদেশের মানুষ যখন বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেছে ঠিক তখনও ঈশ্বরদী শহরে চলে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ।

কয়েকজন পাক সেনা রাজাকার ঈশ্বরদী শহরের অবাঙালি অধ্যুষিত লোকোসেড এলাকায় আত্মগোপন থাকার কারণে ঈশ্বরদী মুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। ৩৩ জন বীর-মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের সশ্রস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের পরই এই দিনে পাক হানাদার মুক্ত হয়।  

সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লে. কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান। দীর্ঘ লড়াইয়ের নয় মাসে ঈশ্বরদী উপজেলার মাধপুর, খিদিরপুর, দাশুড়িয়ার তেতুলতলা, জয়নগরের ভাড়ইমারী, পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রীজসহ বিভিন্ন স্থানে পাক সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বীর-মুক্তিযোদ্ধারা।

ঈশ্বরদী মোট ৬৮৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ভারতে ট্রেনিং নিয়ে লড়াই করেন। তারা বর্তমানে সরকারি ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। এর বাইরে ৬৭ জনের কাগজপত্র ত্রুটিপূর্ণ থাকায় তাদের সুবিধা বঞ্চিত রাখা হয়েছে।

জানা যায়, ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে ঈশ্বরদী উত্তাল ছিল, তবে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার প্রত্যয়সূচক ঐতিহাসিক ভাষণে ঈশ্বরদী তরুণ জনতা প্রস্তুত ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াইয়ের জন্য। ৭ ই মার্চের ভাষণের পর ঈশ্বরদীতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালীন ঈশ্বরদী সাড়া মাড়োয়ারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসাহক আলী।

তৎকালীন ঈশ্বরদী থানা ছাত্রলীগের সভাপতি, নায়েব আলী বিশ্বাস, ছাত্রলীগ নেতা আজমল হক বিশ্বাস, হাবিবুর রহমান মন্ডল, আমিনুল ইসলাম, মঞ্জুর রহমান বিশ্বাস, কাজী সদরুল হক সুধা, আমিনুর রহমান দাদু, মতিয়ার রহমান কচি, মোহাম্মদ রশিদুল্লাহ, খায়রুজ্জামান বাবুসহ অনেকেই নেতৃত্ব দেন।

৭১ এর ২৯ মার্চ পাবনা-ঈশ্বরদী মহাসড়কে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধ সংগঠিত হয় মাধপুর বটতলায়। ওইদিন মূলত কোন কমান্ড ছাড়াই শুধুমাত্র দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে খালি হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তৎকালীন ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান রাজু। এসময় সম্মুখ যুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক, ওহিদুর রহমান, আব্দুল গফুর, নুরুল ইসলাম, আলী আহম্মদ, নবাব আলীসহ ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ৫০ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। পাবনা-৪ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধে পাক সেনারা পালিয়ে যায়।  

৭১ এর ১১ এপ্রিল পাক সেনারা ঈশ্বরদী প্রবেশ করলে হাজার হাজার অবাঙালিকে উল্লাস করতে দেখা যায়। এই নিয়ে পাকশীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তর্ক বাধলে প্রায় ৫০০ অবাঙালিকে পুড়িয়ে মারা হয়। ১২ এপ্রিল ঈশ্বরদী বিহারিরা শুধু বাঙালিদের দোকান ও বাড়ি লুটের ঘটনা ঘটায়নি বরঞ্চ ধরে নিয়ে বহু বাঙালিকে হত্যা করে। শহরের নূরমহল্লা, ফতেমোহাম্মদপুর এলাকায় ৩২ জন বাঙলি এবং একটি হিন্দু পরিবারের ১১ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক বাহিনী।  এছাড়াও যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর নেতৃত্বে ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়া ১১ জন নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে রেললাইনের পাশে কয়লা গুদামে হত্যা করে গণকবর দেয়।  

পাকশি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর-মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলাম হবিবুল তার স্মৃতিচারণ করে বাংলানিউজকে জানান, ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল পাকশীর রূপপুরের তৎকালীন ছাত্রনেতারা সে সময় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন দুটি পৃথক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শরীরচর্চা প্রশিক্ষণ শুরু করেছিল। ছাত্র নেতা কাজী সদরুল হক সুধা, সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচ্চুর নেতৃত্বে জয় বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। সে সময় প্রশিক্ষণ দেন আব্দুল বারী সরদার। পাকশী নর্থ বেঙ্গল পেপাল মিলে কর্মরত মেকানিক ওহিদুল হক মিলের ওয়ার্কসপ থেকে পাইপগান তৈরি করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পাবনা জেলা কারাগার থেকে কয়েদিদের মুক্ত করে দেওয়ার পর পুলিশের কাছে জমাকৃত অস্ত্র তৎকালীন ছাত্রনেতাদের কাছে চলে আসে কিছু সংখ্যক থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এছাড়াও হার্ডিঞ্জ ব্রীজের পুলিশ ক্যাম্পে থাকা ইপিআর, বেশ কিছু সদস্যের কাছ হতে কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল। আরও সহযোগিতা করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিক আব্দুর রব তার ডবল ব্যারেল বন্দুক এসে তোপধ্বনির মাধ্যমে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ করিয়ে সংগ্রাম পরিষদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। সে সময় তৎকালীন জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে।

জুনের শেষে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ঈশ্বরদী প্রবেশ করে। ২৯ জুন প্রথমে ৩৩ জন বাঘইল গ্রামে এসে পৌছে। ৮ জুলাই পাকশী এলাকার টেলিফোনের তার কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরবর্তীকালে জয়নগরের বিদ্যুৎ টাওয়ারে শক্তিশালী এক্সপ্লোসিভ নিক্ষেপ করে। এছাড়াও ঈশ্বরদী বিভিন্ন শান্তি কমিটির দালাল ও নকশালদের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের। ১৪ আগস্ট দাশুড়িয়া শান্তি কমিটির দালাল মাওলানা আতাউর রহমান নিহত হয়। পাকুড়িয়াতে দূর্ধর্ষ ডাকাত মকছেদ আলীকে গুলি করে হত্যা করে মুক্তিকামী জনতা। এছাড়াও নকমাল ননী সরদারের ছিন্ন মস্তক ছলিমপুর হাটের গাছের মাথায় ঝুলিয়ে রাখে মুক্তিযোদ্ধারা।  

উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রশিদুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসে পাবনার ঈশ্বরদীর বিভিন্ন এলাকায় অবাঙালি, রাজাকার ও পাক সেনাদের হাতে অনেকে নিহত হয়েছে। এ ধরনের গণকবর রয়েছে ১০টি। এসব গণকবর  সবগুলোই অরক্ষিত ও অবহেলিত। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে আজও জায়গাগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। ঈশ্বরদী শহরের আলহাজ্ব মোড়ে বিজয়স্তম্ভ, শহরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ হয়েছে। গণকবরগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি উঠেছে কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য বীর-মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান বিশ্বাস বাংলানিউজকে জানান, ঈশ্বরদীতে মুক্তিযোদ্ধা অডোটোরিয়াম নির্মিত হয়েছে। ঈশ্বরদীর গণকবর গুলো অবহেলাতেই পরে আছে, মহান স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর আজও অরক্ষিত হয়ে রয়েছে গণকবরগুলো। মুজিববর্ষে মুক্তিযুদ্ধের এসব ইতিহাস সংরক্ষণ করার দায়িত্ব সরকারের। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচলা করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানাবো।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০২০
কেএআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।