ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অফবিট

বস্তায় বেঁধে পানিতে ফেলে দিলেও ডোবেন না যিনি!

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০২৩
বস্তায় বেঁধে পানিতে ফেলে দিলেও ডোবেন না যিনি!

রাজশাহী: শুরুটা হয়েছিল ৮০ সালের দশকে। সেই সময় তিনি পূর্ণ যুবক।

বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে পানিতে ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা ভেসে থাকতেন। উলটো হয়ে সাঁতার কাটা, সবার পরে নেমেও সবার আগে চলে যাওয়া ও ভেসে ভেসে খাবার খাওয়া ছিল তার বাম হাতের খেল! এখন এই বিস্ময় সাঁতারুর বয়স ৭১ বছর চলছে। কিন্তু এই পড়ন্ত বয়সে এসেও তার শক্তি ও সাহস একরত্তিও কমেনি। হাত-পা বেঁধে বস্তায় পুরে পানিতে ফেলে দিলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিব্যি ভেসে থাকতে পারেন!

তার এই কলাকৌশল দেখে অনেকের চোখই ছানাবড়া হয়ে যায়। কেউ বলেন আধ্যাত্মিক; আবার কেউ বলেন চর্চা ও দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে এই বিশেষ ক্রীড়ানৈপুণ্য আয়ত্ত করেছেন।  তিনি বলেন, ‘চর্চা-তো আছেই তবে এই পুরো বিষয়টিই আল্লাহর দান। ’

নিতান্তই বাজি ধরে একদিন এই ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন সবাইকে। এরপর থেকে এভাবে ভেসে থাকার বিষয়টি দেখে তার নিজের কাছেও অবাক লাগে। কিন্তু শুধু পানিতে ভেসে থাকায় কোনো বিশেষত্ব নেই, নেই বাড়তি আকর্ষণ। তাই এবার হাত-পা বেঁধে বস্তায় পুরে তাকে পানির গভীরে ফেলে দিতে বলেন। কিন্তু এবারও সফল। তারপর জীবনে একাধিকবার একাধিক পুকুরের পানিতে এমনকি উত্তাল পদ্মায়ও অবিশ্বাস্য এবং অসাধারণ এই ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখিয়েছেন ৭১ বছর পার করতে যাওয়া এই বিস্ময় সাঁতারু।

তিনি হলেন রাজশাহীর মোসাদ্দেক হোসেন বাচ্চু। ৭১ বছর বয়সী বাচ্চু এখন রাজশাহীর তেরো খাদিয়া এলাকার বাসিন্দা।

তার গ্রামের বাড়ি পাশের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দাদন চকে। এখন রাজশাহী শহরে বাড়ি করে এখানেই থাকেন। মোসাদ্দেক হোসেন বাচ্চু এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার ছেলে সফিউল্লাহ সুলতান রাজশাহীর বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। আর মেয়ে মুসলিমা খাতুন জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা। মোসাদ্দেক হোসেন এক সময় রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজের প্রধান অফিস সহকারী ছিলেন।

২০১৬ সালের অক্টোবরে অবসর গেছেন। জীবন সায়াহ্নে এসেও মোসাদ্দেক হোসেন বাচ্চু তার অসাধারণ পারদর্শিতা দিয়ে যেকোনো তরুণকে হার মানাতে সক্ষম। শেষ জীবনে এসে তার একটাই ইচ্ছা যে, সাঁতারের এই ব্যতিক্রমী পারদর্শিতা ও দক্ষতার কারণে একদিন তার নাম উঠবে গিনেস ওয়ার্ল্ড বুকে।

হাত-পা বেঁধে বস্তাবন্দি করে পানিতে ফেলে দেওয়ার পরও কীভাবে ভেসে থাকতে পারেন? আর কীভাবেই বা দীর্ঘ সময় ধরে পানিতে ভেসে থাকার এসব ব্যতিক্রমী কৌশল রপ্ত করলেন? সেই সব প্রশ্নের উত্তরে এক এক করে এভাবেই সব কথা জানান মোসাদ্দেক হোসেন বাচ্চু।

কথায় কথায় নানান স্মৃতি ও টুকরো হাসির ছলে তিনি নিয়ে যান জীবনের পেছন পাতার গল্পে। জানান, যখন বাবাকে হারিয়েছিলেন তখন তার বয়স ছয় বছর। একান্নবর্তী পরিবারে তারা চার ভাই ও দুই বোন ছিলেন। তিনি ভাইদের মধ্যে বড় এবং সবার মধ্যে দ্বিতীয়। পিতৃহীন সংসারে তাই শাসন, ডাকহাঁকের কেউ ছিল না। একরকম বাউন্ডুলে, ভবঘুরে ও স্বচ্ছন্দচারী জীবন ছিল তার। কথায় কথা বাজি ধরে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই ছিল তার নেশা। ১৯৮১ সালে কোনো এক ঘটনায় পাঁচ হাজার টাকার জন্য বাজি ধরেন। বলেন, কেউ তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিলে তিনি হাত-পা বাঁধা অবস্থায়ও সাঁতার কেটে দেখাতে পারবেন। না পারলে একই পরিমাণ টাকা তিনি নিজে দিয়ে দেবেন। এরপর তিনি তা করে দেখিয়ে বাজিমাত করে দেন।

এরপর আর কী? প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে বিলের পানিতে নামতেন, সাঁতার কাটতেন। বন্ধুরা ৫০ মিটার এগিয়ে যাওয়ার পর তিনি পানিতে নেমেও তাদের পেছনে ফেলে নিজেদের মধ্যে বিজয়ী হতেন। এরপর রাজশাহীর পদ্মার নদীর একটি চ্যানেলে টানা ১২ ঘণ্টা সাঁতার কাটেন। কেবল তাই নয়, ওই সময় মোসাদ্দেক হোসেন বাচ্চু গভীর পানিতে বুক পর্যন্ত ভাসিয়ে প্লেটে করে খাবার খেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৮৩ সালের এই চ্যালেঞ্জ সম্পন্নের পর তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়।

এরপর হাত-পাসহ দড়ি দিয়ে পুরো বাঁধা শরীর বস্তায় পুরে পানিতে ভাসার কৌশল রপ্ত করেন। আর এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাত-পা না নাড়িয়ে পানিতে ভেসে থাকতে পারেন।

তার ভাষ্য হচ্ছে, বিশেষ কিছু না কারলে তো আর তার এই কলাকৌশল ব্যতিক্রম এবং সবার কাছে আকর্ষণীয় হবে না। তাই আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এই কৌশল রপ্ত করেছেন। আর তার এই ক্রীড়া নৈপুণ্য আল্লাহর দান।

চাকরির কারণে গ্রামের বাড়ি থেকে রাজশাহী চলে আসার পর আর সেভাবে পানিতে নেমে সাঁতার কাটা হতো না।  অবসরের পর আবারও সেই সুপ্ত প্রতিভা জেগে ওঠে। গেল কয়েক মাসে তার এই শখ আবারও মাথা চাড়া দেয়। এরই মধ্যে গেল এপ্রিলের শুরুতে হাতকড়া পরে সাত মাইল সাঁতার কেটে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম ওঠান মিসরের সেহাব আলম। সেই খবর দেখে নিজের পারদর্শিতার কথা মনে ভেসে ওঠে তার। ভেতরে চিন্তা আসে যদি কেবল হাতকড়া পরা অবস্থায় সাঁতার কেটে গিনেস রেকর্ডে নাম ওঠে তাহলে তিনি তো হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাঁতার কাটতে পারেন, বস্তাবন্দি করে পানিতে ফেলে দিলেও ভেসে থাকতে পারেন। তাহলে তার নামও উঠতে পারে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।

মোসাদ্দেক হোসেন বাচ্চু বলেন, এরপর পরই তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) শামীম আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। একদিন তার কাছে গিয়ে এই বিশেষ সাঁতারের দক্ষতার কথা জেলা প্রশাসকের সামনে তুলে ধরেন।

জেলা প্রশাসক জানান, তিনি নিজের চোখে না দেখে কিছুই বলতে পারবেন না। শনিবার (২৯ জুলাই) আশুরার ছুটিতে রাজশাহী জেলা সুইমিংপুলে মোসাদ্দেক হোসেন বাচ্চু তার বিশেষ এ ক্রীড়া কৌশল প্রদর্শন করেন।

এ সময় রাজশাহী জেলা প্রশাসক তার ভেসে থাকা এবং হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটে দেখেন। কিন্তু বয়স বেশি বিবেচনায় ঝুঁকি আছে মনে করে হাত-পা বেঁধে বস্তায় ঢুকে ভেসে থাকা দেখতে রাজি হননি। যদিও তার স্ত্রী মমতাজ বেগম বার বার জেলা প্রশাসককে অভয় দেন যে কিছু হবে না। তার স্বামী আগেও একাধিকবার এগুলো করেছেন।  জেলা প্রশাসক রাজি না হওয়ায় তিনি সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর বাচ্চু তা করে দেখান।

ওই সময় প্রথমেই বাচ্চুর হাত-পা নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর একটি চিকন প্লাস্টিকের বস্তায় তাকে ঢুকিয়ে সেই মুখও বেঁধে দেওয়া হয়। কেবল শ্বাস নেওয়ার জন্য মুখের সামনের অংশের একটু কেটে দেওয়া হয়। এরপর কয়েকজন মিলে তাকে বস্তাসহ সুইমিং পুলের পানিতে ভাসিয়ে দেন।

এ সময় নিরাপত্তার জন্য সুইমিং পুলের কয়েকজন সাঁতারুও নিচে নেমে তার আশপাশে ঘিরে থাকেন। এ সময় সেখানে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কৌতূহলী মানুষ প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে তার অসাধারণ ওই ক্রীড়া কৌশল দেখেন।

তিনি জানান, এভাবে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় পর্যন্ত তিনি ভাসতে পারেন।

এর আগে রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ৭১ বছর বয়সেও মোসাদ্দেক হোসেন বাচ্চু যা করে দেখালেন তা অবশ্যই ব্যতিক্রম এবং প্রশংসনীয়। তার কাছেও মনে হয়েছে অন্য সাঁতারুর চেয়ে তিনি আলাদা। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম ওঠানোর বেশকিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। সবার আগে জানতে হবে দেশের মধ্যে এমন কেউ আর আছেন কি না। তারপর যাচাই-বাছাই করে তার নামের প্রস্তাব করতে হবে। এজন্য সময় প্রয়োজন। যোগ্য হলে তিনি নিশ্চয়ই তার ব্যাপারে সুপারিশ করবেন।  তার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তাকে সাঁতার কাটার পরামর্শ দেন জেলা প্রশাসক।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৬ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০২৩
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।