ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রাজনীতি হোক মানুষের জন্য

আদিল আহমেদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৩
রাজনীতি হোক মানুষের জন্য

স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে অনেক রাজনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে দেশ । নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আবার তার উত্তরণও ঘটেছে।

কিন্তু দুঃখজনক হলো প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ সম্ভব হয়নি। সাম্প্রতিক রাজনীতি দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে প্রচলিত রাজনীতির বাইরে এক অশুভ তৎপরতা শুরু হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিকে উস্কে দিয়ে বিভেদ তৈরির তৎপরতা সাধারণ মানুষকে আতংকগ্রস্ত করে তুলেছে ।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ম কখনোই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি । বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনরা তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছে । সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মের নাগরিকদের রাষ্ট্রের প্রতি মালিকানা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হয়েও ১৯৭৪ সালে ইসলামিক দেশগুলির সমন্বয়ে গঠিত “অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ” (ওআইসি)-এর সদস্যপদ লাভ এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করেন । ১৯৭৮-এ জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিয়োজন এবং বিসমিল্লাহর সংযোজনও রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারেরই ধারাবাহিকতা। তবে ধর্মকে ব্যবহার করলেও তারা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেননি । কিন্তু সেনাপ্রধান এরশাদ ক্ষমতায় এসেই ১৯৮১-তে প্রজ্ঞাপন জারি করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করেন যা পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ করেন । মূলত এ সময় থেকেই এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান শুরু হয়।

দীর্ঘ সময় মুসলিম বিশ্বের আনুকূল্য লাভের চেষ্টায় ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের একটি ইসলামি রাষ্ট্রের বিশেষ মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে এদেশে । তাদের প্রত্যক্ষ অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার কল্যাণে এদেশের সমাজে এবং রাজনীতিতে একটা ধর্মীয় প্রভাব পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। যেটাকে পরবর্তী সব দলই ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার করতে শুরু করে। নির্বাচনের আগে নেতাদের ধর্মীয় পোশাক, হাতে তসবিহ, নামের আগে আলহাজ লাগানোর প্রবণতা শুরু হয়ে যায়। এই কৌশল প্রকারান্তরে ধর্ম থেকে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ারই শামিল। এসব কথার মূল অর্থ হলো স্বাধীনতা-উত্তর এদেশের প্রতিটা সরকার তাদের নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে । জনগণের স্বার্থে কিংবা ইসলামিক মূল্যবোধ থেকে নয় । সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হোক আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলামই হোক--এদেশের জনগণ কোনো তফাৎ বোঝেনি। কোনো মুসলমান যেমন ধর্ম পালনে বাধাপ্রাপ্ত হননি তেমনি সংখ্যালঘু কোন সম্প্রদায়কেও তার ধর্ম পালনে রাষ্ট্রীয় কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি কখনো ।

আজকের এই সহিংস সংঘাতের কারণ দুইটি। প্রথমত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দ্বিতীয়ত যুদ্ধপরাধীদের বিচার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে দেশের ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে গভীর রাজনৈতিক সংকট পুনর্চিত্রায়নের আভাস দিচ্ছিল। ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় নির্বাচন এদেশে কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। দেশের গণতন্ত্রে আবার আঘাত আসতে পারে সেই ভয় থেকে মানুষের মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল হতাশা । এরইমধ্যে যুদ্ধপরাধীদেরে বিচারকে কেন্দ্র করে শাহবাগের উত্থান বদলে দেয় এদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট ।

কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। গন্ধ পায় আঁতাতের। কেননা গত বিয়াল্লিশ বছরে ক্ষমতার রাজনীতির যে নোংরা খেলা এদেশের জনগণ দেখেছে তাতে ক্ষমতায় যাওয়ার সমীকরণ মেলাতে যেকোন কিছুতে আপোষ করতে দ্বিধা করেন না আমাদের রাজনীতিবিদরা। এমনি হতাশা এবং ক্ষোভ থেকে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত কিছু তরুণের শাহবাগ চত্বরের প্রতিবাদ আপামর জনতার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সংহতিতে রূপান্তরিত হয় গণজাগরণে।

তাৎক্ষণিক ঝাঁপিয়ে পড়ে সরকার এই জাগরণকে নিজের ঝুড়িতে ভরতে । বিএনপির শাগবাগ নিয়ে দোদুল্যমানতা সরকারীদলকে সহজ করে দেয় এই আন্দোলনকে আওয়ামীকরণে। এই জাগরণের ফলে আইন সংশোধন এবং সাইদীর ফাঁসির রায়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় জামায়াতে ইসলামের । জামায়াতের অস্তিত্ব হয়ে ওঠে প্রশ্নবিদ্ধ। মরিয়া হয়ে ওঠা জামায়াত খুঁজে পায় শাহবাগের কিছু তরুনণের ধর্মের প্রতি কটুক্তি । মুহূর্তে জামায়াত শাহবাগের আন্দেলনকে নাস্তিকতার মোড়কে আবৃত করে দেয় । অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে জামায়াত দেশের ধর্মীয় সংগঠনগুলিকে সংগঠিত করে দেশের স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষের লড়াইকে পরিণত করতে সক্ষম হয় আস্তিক-নাস্তিকের লড়াইয়ে । তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপিও তার নিজ দলের ঐতিহ্য ভুলে শুধুই ক্ষমতার প্রশ্নে ইসলাম রক্ষার নামে পক্ষ নেয় জামায়াতের । কতিপয় খোলশধারী প্রগতিশীল পন্ডিতও প্রতিক্রিয়াশীল আচরণে লিপ্ত হয়ে উঠে তাদের গোষ্ঠি স্বার্থ রক্ষায় ।

সস্তা জনপ্রিয়তা ও দেশের ধর্মভীরু জনগণের ভোটের আশায় আমাদের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির অপরিণামদর্শী আপোষকামীতা ধর্মভিত্তিক দলগুলিকে আরো বেপরোয়া করে তুলতে পারে । ধর্ম হলো ব্যাক্তিগত বিশ্বাসের ক্ষেত্র । সমাজ ও রাষ্ট্রের সব সমস্যা সমাধানে মুসলিম মৌলবাদিরা যেমন কুরান সুন্নাহর ওপর নির্ভর করতে চায়, এর বাইরের কোন নির্দেশনা নয় তেমনি ইহুদী মৌলবাদীরা তওরাত এর ওপর, খৃষ্টানরা বাইবেলের ওপর নির্ভর করতে চায় । কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রতিটা ধর্মের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন বিষয়ে তাদের পরস্পর বিরোধীতা লক্ষ করা যায় । তাই কোন ধর্মের মৌলবাদকে যদি রাষ্ট্রিয়ভাবে গ্রহণ করা হয় তাহলে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকে না। কারণ, ধর্মীয় রাষ্ট্রে প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্ম নির্দেশিত অনুশাসন মেনে চলতে হয়। সব সিদ্ধান্তই হতে হয় ধর্মের মূল নীতির ভিত্তিতে অন্য কোন মত গ্রহণের সুযোগ থাকে না। তাই কোন ধর্মীয় রাষ্ট্রে অসাম্প্রদায়িক সুস্থ গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

আমরা এদেশকে একটা সুস্থ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। রক্তমূল্যে পাওয়া এদেশ । তাই দেশপ্রেমিক প্রতিটা রাজনীতিবিদ, সুনাগরিক সুশীল সমাজকে এখন এটা ভাবতে হবে যে আমরা কি চাই? আমরা কি একটা সুস্থ নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই নাকি এদেশকে একটা ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই। আজকে যারা ক্ষুদ্র স্বার্থে দেশকে আস্তিক-নাস্তিকে বিভক্ত করছেন আগামীতে এটা তাদের রাজনীতির জন্যও মঙ্গলজনক হবে না। শুধুই ক্ষমতার রাজনীতির অন্তরালে একটা অগণতান্ত্রিক শক্তির যে উত্থান ঘটছে তা এখনি মোকবেলা করতে না পারলে দেশের প্রতিটা রাজনৈতিক দলের রাজনীতিই কঠিন হয়ে পড়বে । কারো ক্ষমতায় থাকা বা কারো ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে ষোল কোটি মানুষের এই দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হতে পারেনা । মৌলবাদের উত্থান মোকাবেলা করতে হবে রাজনৈতিক ভাবে। কোন আপোষকামী অপকৌশলের মাধ্যমে নয় । একটা রাজনৈতিক আদর্শিক ঐক্য, একটা স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই রুখে দিতে পারে মৌলবাদের উত্থান। এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ । অতীতের মত আবারও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে একটা আধুনিক সুস্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষে । নাগরিক সমাজের সুশীল ব্যক্তিদের দলবাজি ত্যাগ করে দেশের স্বার্থে একটা সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনণের পক্ষে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কথা বলতে হবে। জনগণ চায় শুধুই রাজনীতির জন্য নয়, দেশের জন্যই হোক আমাদের রাজনীতি ।
Adil
লেখক: পেশাজিবী
adilcse@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।