ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাবা দিবস: দায়িত্ব পালনের বারতা নাকি অনুষ্ঠান সর্বস্ব

মো. আব্দুল হাই | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৩ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৩
বাবা দিবস: দায়িত্ব পালনের বারতা নাকি অনুষ্ঠান সর্বস্ব

ঢাকা: আদীবাসী মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সারাবিশ্বে পরিবার প্রধান হিসেবে বাবাকে প্রধান ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। প্রাত্যহিক জীবনের আটপৌরে সমস্যাগুলোর সমাধান যেমন বাবাকেই করতে হয়, তেমনি সংসারের কঠিন বাস্তবতায় দৃঢ় ভূমিকা ও বাবাকেই রাখতে হয়।

সন্তানের পিতৃপরিচয় থেকে শুরু করে সন্তান সম্প্রদান পর্যন্ত বাবাকে করতে হয়।

সন্তানের শিক্ষা দীক্ষার ক্ষেত্রে বাবাকে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। সন্তানের প্রতিষ্ঠার জন্য বাবাকে অনুণ চিন্তা করতে হয়। সন্তানের মঙ্গল চিন্তা, পারিবারিক শান্তি বজায় রাখা এবং নিজেদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাবাকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়।

পরিবার প্রধান হিসেবে তাঁকে যেমন বাইরের সব রকম যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করতে হয়; তেমনি ঘরের সমস্যাগুলোও তাঁকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। পরিবারে বাবার ভূমিকা তাই শাসনের আবার একই সঙ্গে পরম নির্ভরতার।

বাবা শব্দটির মধ্যে যেন একটি নিশ্চিত আশ্রয়ের অনুরণন রয়েছে। বাবাকে যেমন আমরা শ্রদ্ধা করি, তেমনি আবার ভয় পাই। ভুল করলে যেমন আমরা বাবাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি, তেমনি কোন সংকটের মুহূর্তে বাবাকে পাশে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি। বস্তুত: বাবাকে ভালবাসার একটি অন্তস্রোত আমাদের হৃদয়ের গভীরে সর্বদাই বয়ে চলে।

বাবার জন্য লালিত এই গোপন অনুভূতির ব্যাত্যয় যে কখনো ঘটেনা তাও নয়। বর্তমানের এই অস্থির এবং ভোগবাদী সমাজে অধিকাংশ পরিবারে বাবা যেন অর্থ উপার্জনের একটি যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে গিয়ে বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে। সন্তানের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের পরিবর্তে আর্থিক সম্পর্কের সূত্রপাত হচ্ছে।

এটি সন্তানের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরিবারের পরিবেশ বিনষ্ট করে। বাবার অনুভূতি ধারণ করার মতো মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে এবং পরিণত বয়সে বাবা ক্রমশ নিঃসঙ্গ হতে থাকেন। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বৃদ্ধ নিবাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পরিবারে ও সমাজে বাবাদের এই নিঃসঙ্গতা ও অসহায়ত্বকেই তুলে ধরে।

২০১২ সালে বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০১০ সময়কালে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই বৃদ্ধ নিবাসের সংখ্যা বদ্ধি পেয়েছে এক হাজার। ২০০৩ সালে ১১ হাজার এবং ২০১০ সালে ১২ হাজার।

মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশে যৌথ পরিবার প্রথা ক্রমশ ভাঙনের মুখে। এতদসত্বেও বাংলাদেশের বাবারা পরিবারের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণে প্রভূত মতার চর্চা করে থাকেন। তবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এ প্রক্রিয়াটি ঘটে থাকে মূলত কর্মক্ষম বাবাদের ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশে বয়স্ক জনসংখ্যার (৬৪+) হার ৪.৫ শতাংশ (৬৫,৪৬,৫২৩ জন) বিশ্ব ব্যাংক-২০১২। এর মধ্যে কর্মক্ষম বয়স্কদের সংখ্যা মাত্র ৭.১ শতাংশ (৪,৬৪,৮০৩ জন)।

উল্লেখ্য, এই পরিসংখ্যানে বাবাদের আলাদা করে দেখানো হয়নি। যদি ধরে নেওয়া হয়, বাংলাদেশে বয়স্ক (৬৪+) কর্মক্ষমদের ৯৯ শতাংশই বাবা, তবু এই বাবাদের কতজন এই বয়সে বাস্তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতে পারেন সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বয়স্ক বাবাদের অসহায়ত্বের চিত্র পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

বলা যায় রোগ শোকে ভুগে জীর্ণ-শীর্ণ, রুগ্ন, অসহায় এবং নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঘরের এক কোণে এই বাবাদের দিনাতিপাত করতে হয়। যে সন্তানের জন্য এই বাবা একসময় নিজের জীবনের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ উপেক্ষা করেছেন বৃদ্ধ বয়সে সেই সন্তানের করুণা ভিক্ষা করে এই বাবাদের বেঁচে থাকতে হয়।

সন্তানের প্রতি বাবার যে দায়িত্ব রয়েছে, সেই একইরকম দায়িত্বশীল আচরণ কাম্য বাবার প্রতি সন্তানের। এটা বোঝানোর জন্য এবং পৃথিবীর সব বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকে বাবা দিবসের শুরু।

ধারণা করা হয় ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গীর্জায় এই দিনটি প্রথম পালিত হয়(উইকিপিডিয়া)। সনোরা স্মার্ট ডড নামে ওয়াশিংটনের এক ভদ্র মহিলার মাথাতেও বাবা দিবসের ধারণা আসে। তিনি ১৯০৯ সালের ভার্জিনিয়ার বাবা দিবসের কথা একেবারেই জানতেন না। সনোরা স্মার্ট ডড সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ ১৯১০ সালের ১৯ জুন থেকে বাবা দিবস পালন করা শুরু করেন।

শুরুতে বাবা দিবসের প্রতি মানুষের আগ্রহ না থাকলেও ধীরে ধীরে অবস্থা পাল্টাতে থাকে। ১৯১৩ সালে আমেরিকান সংসদে বাবা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন বাবা দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস হিসেবে পালিত হয়।

বাবা দিবস সন্তানের সামনে সুযোগ এনে দেয় বাবাকে অন্তরের অন্তর্স্থল থেকে শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সম্মান জানানোর। ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিশ্বজুড়ে বাবাকে পছন্দের জিনিস যেমন ফুল, কার্ড, মগ, টি-শার্ট, নেক টাই প্রদান করা, রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে খাবার গ্রহণ করা, দীর্ঘ ফোন কল করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ক্রিস্টমাস এবং ‘মা’ দিবসের পরে বাবা দিবস বিশ্বে অন্যতম ব্যবসা সফল দিন। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাবা দিবসের গিফট প্রদান খাতে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করা হয়। এই দিনের ব্যবসা সফলতা তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যকে ম্লান করতে চলেছে। বিশ্বজুড়ে আজ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বাবা দিবস কি দায়িত্ব পালনের বারতা নিয়ে আসে, নাকি কিছু প্রতীকী আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য আসে। বাংলাদেশে ও দিনটির ক্রমশ বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়েছে।

তাই সময় এসেছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে, সব সময় বাবাকে সম্মান জানানো এবং পরিবারে বাবার ভূমিকার পূর্ণ মূল্যায়ন করা। এতে পারিবারিক বন্ধন যেমন দৃঢ় হবে তেমনি দিবসটি উদযাপনের যথার্থতা প্রমাণ হবে। এবারের বাবা দিবসের অঙ্গীকার হোক এটাই।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল
সরকারি এম. এম. কলেজ, যশোর।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৭ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৩
সম্পাদনা: প্রভাষ চৌধুরী, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।