ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আয়নায় নিজের চেহারাও দেখুন

পলাশ আহসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৯ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০১৩
আয়নায় নিজের চেহারাও দেখুন

‘রাবিশ’ শব্দটি এলেই অর্থমন্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায়। রেগে গিয়ে তিনি প্রায়ই এই শব্দটি ব্যবহার করেন।

আজকাল কোন কোন সাংবাদিক নিজেকে সেই পর্যায়ে ভাবতে শুরু করেছেন।
 
তবে কারণে-অকারণে ব্যবহারের ফলে ‘রাবিশ’ শব্দটি এখন কেমন গা-সওয়া আর মূল্যহীন হয়ে গেছে। কাউকে বা কোন কিছুকে ‘রাবিশ’ বলা হলেই তা রাবিশ হয়ে যায় না।

দিন দু’য়েক আগে বাংলানিউজে এক লেখায় এই ‘রাবিশ’ শব্দটিই ব্যবহার করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক তুষার আবদুল্লাহ। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ফল প্রকাশে গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনগুলোর নানা ত্রুটি, সংকট আর ভুল বিশ্লেষণ করতে গিয়েই তুষার আবদুল্লাহর এই লেখার অবতারণা।

বোঝাই যায়, লেখার সময় তিনি যথেষ্টই রেগে ছিলেন। এজন্যে একাত্তর টেলিভিশনকে লক্ষ্য করে, এবং একই সঙ্গে নামহীন একজনকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন ‘রাবিশ মিডিয়া কোনহানকার’।

দুর্বল সাংবাদিক অনেক সময় তার নিজের মন্তব্য ‘সংশ্লিষ্টরা বলেন’, ‘দায়িত্বশীল সূত্র জানায়’, ‘বিশেষজ্ঞরা বলছেন’ ইত্যাদি বলে চালিয়ে দেন। তুষার আবদুল্লাহও পুরনো সেই কৌশলই বেছে নিয়েছেন। যদিও একই ধরনের ‘ইঁদুরদৌড়ে’ তিনিও ছিলেন। অতিরিক্ত ভোটের হিসাব দিয়ে পিছিয়েও এসেছেন। সেই তিনিই যদি বড় মন্ত্রীর মতো, নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে একই ভুলের অভিযোগে অন্যের ত্রুটি খুঁজে বেড়ান, তখন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এই লেখা না লিখে পারা যায় না।

অবশ্য নিজের মাছটিও না লুকিয়ে লেখায় রীতিমতো ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি। এর মানে হলো নিজের বিরাট ভুলকেও, নিজেই ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার ‘ভান’ তিনি করেছেন। তবে পুরো লেখা জুড়ে তিনি একাত্তর, ইন্ডিপেন্ডেন্টসহ দু’একটি টেলিভিশনের যে কঠোর সমালোচনা করেছেন, তাতে নিজের দিকে তাকানোর সময়ই হয়তো তিনি ঠিকমতো পাননি।

লেখায় তিনি বলছেন, শুরু থেকেই টেলিভিশন চ্যানেলগুলো রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ফল অনুসরণ করেনি। কথা খুবই সত্য। এমনকি যখন রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কোনো ফলই ঘোষণা করা হয়নি, তখন অনেক টেলিভিশনই ফল দিতে শুরু করে দেয়। অসুস্থ প্রতিযোগিতার শুরুটা এখান থেকেই। আর কয়েকটি টেলিভিশনের সঙ্গে এই প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে সময় টেলিভিশনকে।

যখন সময় টেলিভিশন ৩টি কেন্দ্র থেকে পাওয়া ফল প্রচার শুরু করে, তখন রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কি ফলাফল প্রকাশ শুরু হয়েছিল? তারপর অন্য কয়েকটি টেলিভিশনের মতো সময় টেলিভিশন যে গতিতে ফলাফল প্রচার করতে থাকে, সেগুলোর সূত্র কি?

এটা খুবই সত্য যে বিভিন্ন চ্যানেল নানা রকম তথ্য পরিবেশন করছিল। যেসব তথ্যের মধ্যে মিলও খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছিল না। এটি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফল। আর এতে দর্শকরা বিভ্রান্ত হয়েছেন।

দর্শক দ্রুত ফল দেখতে চান। আর দর্শকের এই আগ্রহকে মাথায় রেখে বিশেষ এই দিনটিতে অনেক গণমাধ্যম যাচাই-বাছাইয়ের ধার ধারতে চায় না। সেই তালিকায় কি সময় টেলিভিশন ছিল না?

ফলাফল প্রকাশের সম্পূর্ণ অধিকার কেন্দ্রে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার, আর সব মিলিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার। পরে সেই ফল গ্যাজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। তাহলে আদর্শ নিয়ম অনুযায়ী, আমাদের সবারই তো রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া ফলই অনুসরণ করা উচিত। তাই নয় কি? তাহলে তা কেন সবাই অনুসরণ করলো না?

যে কোনো সূত্র থেকে যেনতেন উপায়ে ফলাফল প্রকাশের ধারা শুরু হয়েছে সাম্প্রতিককালে। বিশেষ করে এই ধারা প্রকট হয়েছে গত চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়। তাহলে সবাইকেই একটি জায়গায় ঐকমত্যে আসতে হবে। দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে সবাইকে একটা সিদ্ধান্তে তো পৌঁছ‍ুতে হবে। সেটা দর্শকদের স্বার্থেই।

বড় কথা বিভ্রান্তি দূর করার স্বার্থে। আর এভাবে নির্বাচনের ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে ফলাফলের উপর প্রভাবও কি পড়ে না, পড়তে পারে না? সেই ঝুঁকি গণমাধ্যমগুলো কেন তৈরি করে দিচ্ছে?

কোন টেলিভিশন কোন সময় কত ভোটের সংখ্যা দেখাচ্ছিল তা উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন তুষার আবদুল্লাহ।

তিনি লিখেছেন, ‘যদিও সময় টেলিভিশন প্রায় এক ঘণ্টা ২০৩টি ভোট কেন্দ্রতে টেলিভিশন প্রতীকের ভোট দেখিয়েছিল ২ লাখ ৩০ হাজার এবং দোয়াত-কলম প্রতীকে ১ লাখ ২৮ হাজার। পরে তারা ভোটের সংখ্যা কমিয়ে আনে’। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সময় টেলিভিশন এই সংখ্যা কমিয়ে আনলো? সংকটটা কোথায় ছিল? এর কোনো ব্যাখ্যা কিন্তু লেখায় পাওয়া গেল না।

শুরু থেকেই একাত্তর টেলিভিশন ভুল সংবাদ দেওয়ার চেয়ে সতর্ক থাকার অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে তুষার আবদুল্লাহ ঠিকই বলেছেন, ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই একাত্তর টেলিভিশন ছিল সংযমী। যাকে অনেকেই পিছিয়ে থাকা বলার চেষ্টা করে। এই অপবাদ মাথায় নিয়েও বস্তুনিষ্ঠতার স্বার্থে গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসানোর সিদ্ধান্ত ছিল কর্তৃপক্ষের। তুষার আবদুল্লাহ তার লেখায় এই কৃতিত্ব দিয়েছেন প্রথম আলো আর বিডিনিউজকে।

যে জায়গাটি নিয়ে জনাব তুষার আবদুল্লাহ’র যত ক্ষোভ, দু:খ তা হচ্ছে তারা এতটা এগিয়ে থাকার পর হঠাৎ করে একাত্তর আর ইন্ডিপেন্ডেন্ট কি করে তাদের আগে ব্রেকিং দিয়ে দিল। এতে সংখ্যাগত বড় তারতম্য, তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চান তিনি। বড় অপরাধী প্রমাণ করতে চান একাত্তরকে।

জনাব তুষারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে স্বীকার করে নিচ্ছি, সংখ্যাগত তারতম্য একাত্তরে প্রচারিত সংবাদে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে কম থেকে কেন হঠাৎ করে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো, সেই প্রশ্নও এসেছে।

জানার জন্য বলছি, লক্ষ্য করে থাকবেন- একাত্তর ফল প্রকাশে দু’টি উপায় অবলম্বণ করেছে। প্রথমটি স্ল্যাগ এর মাধ্যমে। এখানে অসমর্থিত সূত্র উল্লেখ করে ফল দেওয়া হচ্ছিল। আরেকটি পিআইপিতে গ্রাফিক্স করে।

পিআইপিতে ছিল রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া ফল। এটা দর্শকদের কাছে স্বচ্ছ থাকার প্রয়াস থেকে করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই কৃতিত্ব তুষার আবদুল্লাহ দিতে না চাইলেও, দর্শক নিশ্চয়ই বুঝেছেন টেলিভিশের মধ্যে একমাত্র একাত্তরই সেদিন রিটার্নিং কর্মকর্তার ফলও সমানতালে দিয়েছিল।

তুষার আবদুল্লাহ লিখেছেন, ‘একাত্তরে একটি পর্যায়ে প্রচার করা হয়, ৩৯২টি ভোটকেন্দ্রের সবগুলোতে অধ্যাপক মান্নান পেয়েছেন ৪ লক্ষ ৬৮ হাজার ভোট। দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে আজমত উল্লাহ পেয়েছেন ৩ লক্ষ ১২ হাজার ভোট। এতে ভোট দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮০ হাজার। ’

মজার ব্যাপার হলো- সবাই যে সূত্র ব্যবহার করে ওইদিন ঘোড়দৌড়ে মেতেছিল, এই ফলও সেই একই সূত্র থেকে পাওয়া। এখন কেন্দ্র অনুসারে ফলাফল এবং ভোটারের সংখ্যা যোগ করলে টেলিভিশনগুলো কোন সূত্র উল্লেখ করে যে ফল প্রকাশ করছিল, তার শেষ সংখ্যাটি এটিই দাঁড়ায়। একাত্তর টেলিভিশন মনে করে, চূড়ান্ত এই ফলাফল ‘অসমর্থিত’ ব্যানারে ঘোষণা করা যেতে পারে। যেহেতু একই সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তার ফলাফলটিও ছিল।

তারপরও বলছি, তখন পর্যন্ত কি পরিষ্কার জানা গিয়েছিল- আসলে কত শতাংশ ভোট পড়েছিল? প্রথমে জানা গেল, প্রায় ৬০ শতাংশ, পরে তা হলো ৬৫ শতাংশ। পরে বলা হচ্ছিল, ৭৮ শতাংশ। শেষটায় যে প্রায় ৮০ শতাংশ নয়, সে ব্যাপারে কে নিশ্চয়তা দিয়েছিল তখন? হতেও তো পারতো ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে।

অসুস্থ আর অপ-সাংবাদিকতা করার বহু উদাহরণ অনেকের জন্যে প্রযোজ্য। যদিও তা কাম্য নয়। জুতা পরে কবরে নেমে রিপোর্টারের পিটিসি দেওয়া কিংবা রানা প্লাজার অন্ধকূপ থেকে ১৭ দিন পর উদ্ধারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সময় টেলিভিশন একেবারে আইসিইউতে ঢুকে সরাসরি লাইভ নিউজ করার নামে খুব দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে?

প্রতিযোগিতার কারণে অনেকেই নিজেদের দায়-দায়িত্বও ভুলে যান। তাই আয়নায় নিজের চেহারাটাও দেখুন।
লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০১৩
জেডএম/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।