ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অবমাননা কি পুরুষেরও নয়?

ড. গীতি আরা নাসরীন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৩
অবমাননা কি পুরুষেরও নয়?

হাটহাজারী মাদ্রাসার ইসলামী মহাসম্মেলনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর শাহ আহমদ শফীর নারী-পুরুষ বিষয়ক সাম্প্রতিক কদর্য উক্তি সঙ্গত কারণেই সাইবার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়ার ঝড় তুলেছে।

নারীর জনপরিসরে যাওয়া উচিৎ নয়, তার এ ধরনের বক্তব্যের উত্তরে রাসুল (সা.) এর স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.) যিনি ষষ্ঠ শতকেই একজন ব্যবসায়ী ছিলেন, স্ত্রী জয়নব (রা.) দরিদ্রের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন, কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.) যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন – নজিরগুলো  অনেকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।



এসবে প্রমাণ হয়, আহমদ শফী শুধু একবিংশ শতকের বাস্তবতায় নয়, ইসলাম ধর্ম অবতীর্ণ হওয়ার সময়ের চেয়েও পশ্চাৎদপদ মানসিকতার। এতখানি অজ্ঞ ও অশ্লীল মানুষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়া অসম্ভব, এমনকি ধর্মীয় নেতৃত্ব দেওয়াও যুক্তিযুক্ত কিনা সেটি ইসলামী ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে বিবেচনা করতে অনুরোধ করছি।

আমার সীমিত জ্ঞানে জানি, কোরআন শরীফে পুরুষকেও চোখের পর্দা করতে বলা হয়েছে এবং নিজের সম্ভ্রম বজায় রাখতে বলা হয়েছে (সুরা আল নূর ২৪:৩০-৩১)। সুরা আযহাবে কুৎসা দিয়ে নারীর চরিত্রে কালিমা লেপনে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে (৩৩: ৫৩-৭৩)।

যিনি পুরুষদের দৃষ্টি নত করতে না বলেন, নারী দেখলেই পুরুষের কামনার উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক (না হলেই ‘ধ্বজভঙ্গ’) বলে সম্মেলনে সবক দেন, তিনি ইসলাম ধর্মেরই অবমাননা করছেন।

যিনি নানা অশ্লীল কথায় কর্মরত বা শিক্ষারত নারীচরিত্রে কালিমা লেপন করছেন, তিনি কোরআন শরীফ-প্রদত্ত শিক্ষারও অবমাননা করছেন। প্রকৃত ধর্মজ্ঞানী মানুষ ইসলামী সম্মেলনে উপস্থিতদের এ ধরণের ভ্রান্ত শিক্ষায় উত্তেজিত করার অশুভ দিকগুলি সম্পর্কে জনসাধারণকে অবগত করবেন বলেই আমাদের প্রত্যাশা।

দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সেই একেবারে ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো ওয়াজ শুনেছি – সেগুলোতে বেশিরভাগ সময়ই নারী-প্রসঙ্গ টেনে আনা হত, “নারী যে সব পাপের মূল’ একথাটাই নানা সময়, নানাভাবে শুনতে হয়েছে। নারীকে সম্মানিত মনে হয়নি। ইসলাম ধর্ম নারীকে যে সম্মান দিয়েছে বলে অনেকের কাছে শুনতে পাই, গ্রামে-শহরে যারা ওয়াজ করছেন, তারা কতটুকু সেকথাটা বলছেন, সে’টা খতিয়ে দেখা দরকার।

পথে-ঘাটে, চায়ের দোকানে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী’র ওয়াজের ক্যাসেট বাজতে শুনে আমি প্রায় বিশ বছর আগে তার অনেকগুলো ক্যাসেট কাঁটাবন থেকে কিনে শুনেছি। নানাবিধ অবমাননাকর বক্তব্যের মধ্যে তার ‘ছেলা-কলা’ সম্পর্কিত উদাহরণটি অনেকের জানা। হিজাব পালন না করা মেয়েদের তিনি খোসা-ছাড়ানো কলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ছেলা-কলা যেমন কেউ কেনে না, তেমনি পর্দাহীন নারীতে পুরুষ আকৃষ্ট হয় না--এই তার মূল কথা। তার কথার সারাৎসার হলো, ‘নারী খাদ্য, পুরুষ খাদক’। নারীকে তো নয়ই, নারীর খাদক হিসেবে উপস্থিত করে পুরুষকেও যে তিনি কোনো সম্মান দেখিয়েছেন একথা বলা যাবে না।

অনেকে মনে করেন, এ ধরনের কদর্য বক্তব্য সম্বলিত বয়ানকে বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। এটা যারা মনে করেন, তারা বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মানুষের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন।

অসংখ্য মানুষের কাছে, এ ধরনের কদর্য বয়ানই জীবন সম্পর্কে পাওয়া প্রধানতম শিক্ষা। ধর্মীয় নেতাদের মুখ থেকে যখন নিঃসৃত হয়, তখন তারা একেই ধর্মবাণী বলে বিশ্বাস করেন। আহমেদ শফি, দেল‍াওযার হোসাইন সাঈদীর মতো এরকম আরো অনেক ধর্মীয় শিক্ষক চটুল নানা কথা বলে নারীর ধর্ষণ-নির্যাতনকে জায়েজ করেন। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারনার সঙ্গে তা মিলে যায় বলেই, তাদের কথাগুলো আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। ‘সুরুচি’-সম্পন্ন মানুষের কাছে শফি-সাঈদীর কথাগুলো স্থুল বটে, কিন্তু নারী ধর্ষিত বা নির্যাতিত হওযার জন্য যারা নারীর পোশাককে বা আচরণকে দায়ী করেন, তারা আদতে ঘুরে ফিরে শফি-সাঈদীইর মতানুসারী।

তারা বিশ্বাস করেন, ‘পুরুষের যৌনকামনা সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত’, ‘পুরুষ সর্বক্ষণই কামনা-কাতর’ এবং ‘পুরুষ কামুকতার অযাচিত প্রকাশ হলে তার দায় পুরুষের নয়’।

সামাজিক মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, অনেকে আবার আহমেদ শফির ভয়ঙ্কর বক্তব্যকে শুধু ‘তেঁতুল’-কেন্দ্রিক ঠাট্টা-তামাশার বিষয় করে ফেলে, একে শুধু হালকা করেই দেখছেন না, কখনো নতুন ধরনের নিপীড়নের পরিস্থিতিও সৃষ্টি করছেন। বোঝাবার জন্য উদাহরণ দেই, সিনেমার নারী-নিপীড়নমূলক সংলাপ অনেক সময়ই পথে-ঘাটে নারীকে উত্যক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ‘একা নাকি?’ ‘আয় যাইগা’ – এ ধরনের সংলাপ আমার নিজের কানেই শোনা। এখনকার ভুক্তভোগীরা নিশ্চয়ই নতুন উদাহরণ দিতে পারবেন। এ ধরনের টিজিং যারা করে, তারা সবাই কিন্তু ‘বখাটে’ নয়। অনেক তরুণই তাদের তারুণ্যের স্বাভাবিক প্রকাশ হিসেবে এ ধরনের নিপীড়নমূলক কথা বলতে শেখে। ঠিক তেমনি, সম্প্রতি ফেসবুকে সারাক্ষণ তেঁতুলের ছবি লাগানো এবং তার সঙ্গে নানা সরস সংলাপ যে কতখানি নির্যাতনমূলক তা শুধু ‘তেঁতুলে’ পরিণত করা নারীরাই বুঝতে পারছেন।

আহমেদ শফি শুধু নারীকেই অপমান করেন নি, পুরুষকেও করেছেন। তার কথা অনুযায়ী পুরুষ নারীদর্শনমাত্রই কামকাতর এবং লালাসিক্ত হয়। যে পুরুষ হয় না, সে যৌন-অক্ষম। আহমেদ শফির যৌনক্ষমতা নিয়ে হাসাহাসিই কি এর উত্তর? পুরুষদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ শুনছি না কেন?
Gitiara-nasrin

ড. গীতি আরা নাসরীন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ngitiara@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৩
জেডএম/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।