ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নির্বাচনী আচরণবিধির সংশোধনী সংকট বাড়াবে

এরশাদুল আলম প্রিন্স, আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৩
নির্বাচনী আচরণবিধির সংশোধনী সংকট বাড়াবে

রাজনৈতিক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনই গণতান্ত্রিক রীতি। আওয়ামী লীগ প্রচলিত সেই রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে।

তাও আবার আদালতের নির্দেশনা মেনে। পঞ্চদশ সংশোধনীর পেছনের রাজনীতি যাই হোক--সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সেরকমই বলে আসছেন।

আমাদের দেশের আজকের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তা মূলত দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বজায় না থাকার ফল। বিশেষ করে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুই বছর রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার পর সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করার প্রয়োজনীয়তা আরো ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়। সে আলোকেই পঞ্চদশ সংশোধনী। তবে, হয়তো কাজটি একটু বেশিই তড়িঘড়ি করেই করা হলো।

এ সংশোধনীর ফলে চলমান রাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে পারে; গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অর্জন করা যাবে না।

কারণ, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা’ও সম্পন্ন হতে হয় একটি যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়।

ক্ষমতা হস্তান্তরের এ আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যে পারস্পরিক আস্থাহীনতা বিরাজ করছে তার আশু সুরাহা না হলে রাজনীতির বিকল্প অপশক্তিগুলো যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

প্রচলিত গণতান্ত্রিক কাঠামোর পথে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের অভিজ্ঞতা আমাদের খুবই কম। বিপত্তিটি সেখানেই। আস্থাহীনতার উৎপত্তিও সেখান থেকেই।

আমরা ওয়েস্ট মিনস্টার ডেমোক্রেসির কথা বলে মুখে ফেনা তুলি কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোপথ দিয়েই হাটি।

গণতন্তের মূল কথা-জনগণের ক্ষমতার ওপর আস্থা রাখা- যা আমরা মুখে আওড়ালেও বুকে ধারণ করিনা। ফলে, যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকতে চাই। এই রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচরণ থেকে মুক্ত না হতে পারলে সংবিধানের কোনো সংশোধনীই কাজে আসবে না।

সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী করার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাত দিয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো-১/১১র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিক্ত অভিজ্ঞতা। কিন্তু সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংযোজন বা ১/১১-সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার প্রেক্ষাপট বা ইতিহাস বিবেচনায় না নিলে কোনোভাবেই রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিদ্যমান সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়ার জন্য প্র্রধান দুটি দল বা তাদের জোট কোনো রকম চেষ্টাও করেনি। এক্ষেত্রে বিরোধী দলতো তাদের চরম রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রদর্শন করেছে। আর সরকার কেবল সে সুযোগটিই গ্রহণ করেছে।

গত সাড়ে চার বছরে বিরোধীদলকে সংসদে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে দেখিনি। অথচ আলোচনা ও বিতর্ক করার অসংখ্য বিষয় ছিল তাদের সামনে। তারা নানা সময়ে নানা অজুহাতে দিনের পর দিন সংসদ বর্জন করেছেন। সংসদে আলোচনা বা বিতর্ক যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে না।

গত বাজেট অধিবেশনে বিরোধী দলকে আমরা সংসদে যোগ দিতে দেখেছি। সংসদে হয়তো তাদের প্রস্তাব কণ্ঠভোটেই নাকচ হয়ে গেছে; কিন্তু তারা সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি বেশ সফলভাবেই জাতির সামনে তুলে ধরতে পেরেছে। এটিই সংসদীয় রাজনীতির প্রাপ্তি।

সংসদকে পাশ কাটিয়ে, বা অধিবেশনে যোগ না দিয়ে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আদায় করা এখন প্রচলিত রাজনীর অংশ। এব্যাপারে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি উভয় দলই নীরব।

কারণ, বিরোধীদল সংসদে যোগদান করেনি এটি যেমন সত্যি তেমনি আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও কোরাম সংকটের জন্য সংসদ অধিবেশ বসতে পারেনি এটিও বাস্তবতা। কাজেই সংসদের প্রতি অবহেলায় কেউ কারো চেয়ে কম যায় না।

অথচ, এই মাননীয়  সংসদ সদস্যরাই গাড়িতে সংসদের স্টিকার লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান। আর সংসদে তাঁর আসনটি ফাঁকা থাকে দিনের পর দিন।

সামনে নির্বাচন আসন্ন কিন্তু সে লক্ষ্যে কার্যকর কোনো আলোচনা আমরা দেখতে পাচ্ছিনা। সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী করে তার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। আর বিরোধীদলও তাদের সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের দাবীতেই বহাল আছে। এরকম একটি বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে দিয়ে আমরা জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ না হলে সেটি কেবল দুই দলের জন্যই নেতিবাচক হবে না, গণতন্ত্রের জন্য হবে আরো বড় চ্যালেঞ্জ।

ইতিমধ্যে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে সরকার সংশোধীত সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইনগুলো সংশোধন করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। যেহেতু সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে একটি আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাই নির্বাচনী আচরণবিধিরও পরিবর্তন জরুরি। অন্যদিকে নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে হবে তা নিয়েও বিপাকে আছে কমিশন।

কমিশন অবশ্য বলছে, তারা দুই সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, কমিশন বর্তমান সরকারের অধীনেই যে আগামী নির্বাচন হবে সে বিষয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী নয়। এটি যদি বর্তমান সরকারেরও ইঙ্গিত হয়ে থাকে, তবে সরকারকে ঝেড়ে কাশি দেওয়াই ভালো।

কমিশনের পক্ষে সংবিধানের বাইরে অন্য কোনো বিকল্প পথে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তাই সরকারকেই সম্ভাব্য সব পথ আগে থেকেই বাতলে দিতে হবে। সম্ভাব্য সেই পথগুলো যতো আগে নিশ্চিত হওয়া যাবে পথচলাও ততো দৃঢ় ও নিরাপদ হবে। এটি, সরকার ও বিরোধীদল উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য।

সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি মৌলিক বিষয় হলো প্রার্থীদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। কিন্তু নতুন করে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে কেবল মন্ত্রীরাই নন, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্ধারিত আরো বিশ জন ব্যক্তি নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নিতে পারবেন। এই বিশ জন হতে পারেন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা সম্পন্ন। অর্থাৎ নির্বাচনের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লাইসেন্স প্রাপ্ত এই বিশ জন নির্বাচনের মাঠ দাবিয়ে বেড়াবেন।

নতুন এ বিধানটি আগামী নির্বাচনে যদি বহাল থাকে (যদি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়) তাহলে আওয়ামী লীগ হয়তো সুবিধা পাবে; কিন্তু যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারে তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই বিধানটিই কি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না?

আইন সংশোধনের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যমান কোনো একটি বিষয়ের উত্তরোত্তর মঙ্গল সাধন। কিন্তু আমাদের দেশে হয় উল্টোটা। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের নতুন সংশোধনীটি তারই একটি উৱকৃষ্ট প্রমাণ। কারণ, বিদ্যমান আইনে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীরা কোনো ব্যক্তির নির্বাচনি কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না।

কেবল অনির্বাচিত সরকারের (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) অধীনেই নয় অতীতে নির্বাচিত সরকারের অধীনেও যতো নির্বাচন হয়েছে সেখানেও এ বিধানটি ছিল না।

অতীতে কেবল প্রধানমন্ত্রীই নন, অন্য সব মন্ত্রীরাও পদত্যাগ করে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতো। আর এখন তারা গদিতে বসেই গদির লড়াই চালিয়ে যাবেন (৫৬ এর ৪ অনুচ্ছেসহ আরো অনুচ্ছেদ মোতাবেক)।

তাই বলছি, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো সরকারের অনুকূলে সংশোধন করা নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযেগ্যতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

অতীতে আমরা দেখেছি, অতি তুচ্ছ কারণে নির্বাচন কমিশনকে বর্জন করে তার অধীনে নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েছে একাধিক বিরোধী দল। আমরা নিশ্চয়ই বর্তমান কমিশনের সেই পরিণতি দেখতে চাইনা।
দু:খজনক হচ্ছে, বিরোধীদলও আইনের এ সংশোধনীগুলোর বিষয়ে মুখ খুলছে না ।

গত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরে বিএনপি নির্বাচন আইন বা নির্বাচন কমিশন নিয়ে তেমন কোনো কথা বলছে না । তারা হয়তো ভেবেই নিয়েছে যে আগামী নির্বাচনে  তারাই ক্ষমতায় আসবে। তাই সরকার যা খুশি করুক। ক্ষমতায় গেলে আমরা এর সুবিধা নেবো...। যদি বিষয়টি তাই হয়, তাহলে ভেবে দেখুন আইনকে কীভাবে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তাই নতুন কোনো সংশোধনী আনার আগে ভেবে চিন্তেই তা করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৩
আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।