খুব ছোট যখন ছিলাম, বয়স চার কি পাঁচ, ঈদের দিন বড় বোনের হাত ধরে তার বান্ধবীর বাড়িতে যেতাম। নার্গিস আপা, আমাদের প্রিয় নার্গিস আপার বাসায়।
বয়সের কারণে ঠাকুরমা’র কথার অর্থ খুব বেশি না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিলাম, যাদের বাড়িতে যাচ্ছি তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে, তারা খুব ভাল না।
শিশু বয়সেই খুব অবচেতনভাবে আমার মধ্যে সাম্প্রদায়িতকার বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন সরলমতি, সংশয়ী ঠাকুরমা। সেসময় তার কথাকে বেদবাক্য মেনে আমরা সাবধানই থাকতাম। কিন্তু ঈদের দিন নতুন জামা পরে প্রতিবেশীর বাড়ি যাওয়া ঠেকাতে পারেন নি ঠাকুরমা বা আর কেউই।
সেই আমি দিনের পর দিন আমার ঘরের চালে নার্গিস আপার ভাইদের ঢিল পড়তে দেখেছি, মন্দিরে আগুন দেওয়া দেখেছি। হিন্দু হওয়ার অপরাধে আমাকেও রাতের পর রাত জেগে ভিটেমাটি রক্ষায় পাহারা দিতে হয়েছে। সাম্প্রদায়িক পাণ্ডাদের নির্যাতন সইতে না পেরে প্রতিবেশীদের ভারতে পাড়ি দেওয়া দেখেছি।
এসব ঘটনা আমার চেয়ে আরও বেশি দেখেছিলেন আমার ঠাকুরমা। দেখে দেখে তিনি হয়ত তার জীবনযাত্রায় সব সময় হাত বাড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীটার বিষয়েও খুব সতর্ক হয়ে উঠেছিলেন। খুব স্বাভাবিক ছিল এসব দেখে দেখে ঠাকুরমার দেওয়া বিষটাকে আমার মাথার ভেতর স্থায়ীভাবে আসন করে দেওয়া।
কিন্তু না, সেটি হয়নি। কারণ, কয়েক পাণ্ডার উন্মাদনার চেয়েও বেশি দেখেছি পহেলা বৈশাখ। হাতে হাত ধরে বর্ষবরণের গান গাওয়া, পান্তা-ইলিশ খাওয়া কিংবা চৈত্র সংক্রান্তি আর লক্ষ্মী পূজায় মিলেমিশে নাড়ু খাওয়ার উৎসবও তো আমার, আমাদের।
স্কুল জীবনেই প্রগতিশীল রাজনীতিতে জড়িয়েছিলাম, অসাম্প্রদায়িকতার শ্লোগান তুলেছিলাম। এখনও আমি, আমরা ঈদের দিন নতুন জামা পরে বন্ধু মইনুলের বাড়ির দিকে ছুটি। যে আমি বড় হয়ে দিনের পর দিন সাবাড় করেছি গোমাংস, সেই আমিই আবার বিজয়া দশমীতে মইনুলদের নিয়ে মন্দিরে হইচইয়ে মেতে উঠি।
অসংখ্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের দেশে সাম্প্রদায়িক গুটিকয়েক পাণ্ডার নির্যাতন আমাকে দূরে সরাতে পারেনি, পারবেও না। হেফাজত আর জামায়াত নামের অন্ধকারের ফেরিওয়ালারা যতই আমাদের দূরে সরাতে চাইবে, ততই আমরা এক হয়ে যাব। হাতে ধরব হাত, সবাই মিলেমিশে সমস্বরে আকাশ পানে চিৎকার করে বলব, ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক। আমাদের চিৎকারের ধ্বণি, শুভবোধের শক্তি পরাভূত করবে সব অন্ধকারের ফেরিওয়ালাদের।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৯,২০১৩
আরডিজি/সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর ও স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট/জেডএম