ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কী অমানবিক, কী জঘন্য রাজনীতি!

পীর হাবিবুর রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৩
কী অমানবিক, কী জঘন্য রাজনীতি!

১.
এত অমানবিক, মর্মান্তিক ও হৃদয়হীন রাজনীতি দেখেনি বাংলাদেশ আর কখনো। এমন নির্বোধ সরকার ও বিরোধী দল দেখেনি মানুষ।

কী জঘন্য রাজনীতিই না চলছে এখন! কেউ কোথাও নিরাপদ নন। মানুষের মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। মানুষের সম্পদহানির পরিমাণ বাড়ছে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ কতটা নির্লজ্জপনার উচ্চতায় উঠলে লাশের পাহাড় টপকে ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার ও থাকার লড়াইয়ে মগ্ন চলমান রাজনীতি হতে পারে! মহাত্মা গান্ধী অহিংস আন্দোলনের যে বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তা এখানে আজ নির্বাসিত।

গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির আলো নিভে গেছে আজকের বাংলাদেশে। মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গণমানুষকে নিয়ে মোটা ভাত-কাপড়ের সংগ্রামের যে সূচনা ঘটিয়েছিলেন তা এখানে ধূসর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন যে আন্দোলন-সংগ্রামের দৃশ্যপট ইতিহাসের ক্যানভাসে রেখে গেছেন একটি জাতিকে ঐক্যের সুতোয় বেঁধে সেই রাজনৈতিক আন্দোলন এখানে মৃত। আমাদের রাজনৈতিক পূর্বসূরিদের গৌরবের অতীত ভুলে গিয়ে আজকের জাতীয় নেতৃত্ব কলঙ্কের এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করছেন।

২.
 সেনাশাসন জমানায়ও উত্তাল আন্দোলন দেখেছে বাংলাদেশ। দেখেনি চলন্ত যাত্রীবাহী বাসে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে মানুষের জীবন কেড়ে নিতে। যে আন্দোলন চলছে তা যেন আজ মানুষের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। রেললাইনের ওপর নজিরবিহীন নাশকতা শুরু হয়েছে। চলন্ত ট্রেনে আগুন দেওয়া হচ্ছে। রেললাইন তুলে নেওয়া হচ্ছে। দেশজুড়ে যেখানে সেখানে বোমা, ককটেল হামলা চালানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ মরছে। এই জঘন্য রাজনীতির দায় সংসদীয় রাজনীতির বিচারে ১৮ দলীয় জোট নেত্রী জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এড়াতে পারেন না।

নির্বিকার সরকার জনসমর্থনহীন জোটশক্তিদের সঙ্গে নিয়ে পথ হাঁটলেও রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ার মাধ্যমে এই সহিংসতা এড়ানোর দায় এড়াতে পারে না। শাসকজোটে কারা আছেন না আছেন তারা মুখ্য নন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমঝোতার জন্য বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে গণভবনের নৈশভোজে যে দাওয়াত করেছিলেন তা এখনো বহাল রয়েছে। প্রয়োজনে আবার দাওয়াত করতে পারেন। সময় ফুরিয়ে শেষ প্রান্তে। গভীর গাঢ় অন্ধকার সময়ের মুখোমুখি বাংলাদেশ। বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া এই মানুষ ও সম্পদ হত্যার বর্বরোচিত অমানবিক অবরোধ-হরতাল কর্মসূচির পথ বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে টেলিফোন করে গণভবনে গিয়ে তার ন্যায্য দাবি তুলে ধরতে পারেন। বলতে পারেন, আপনি সরে দাঁড়ান। নির্বাচনকে আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিতে পারেন।

৩.
স্বজন হারানোর বেদনায় শোকার্ত মানুষের কান্না-আহাজারিতে দেশের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। বাতাসে এখন শুধুই লাশের গন্ধ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এখন মানুষ পোড়ার গন্ধ, আর্তনাদ ও আহাজারি। এই রাজনীতি কি মানুষের কল্যাণের? এই রাজনীতি কি গণতন্ত্রের? এই রাজনীতির নাম কি জনসেবা? দেশপ্রেম? মানবতা? এই জঘন্য মানবতাবিরোধী রাজনীতির জন্য সুমহান মুক্তিযুদ্ধে মায়ের বুক খালি করে সন্তান যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়নি। এই কালো রাজনীতির জন্য নবজাতক সন্তানের মুখ না দেখে রণাঙ্গনে জীবন দেয়নি বীর বাঙালি। এই অমার্যনীয় অপরাধের রাজনীতির জন্য নববধূকে ফেলে রেখে মুক্তিযুদ্ধে জীবন দেয়নি সাহসী তরুণ।

এই রাজনীতির জন্য লাখো শহীদের রক্ত আর আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ঝরেনি। এই গণতন্ত্রের রাজনীতির জন্য রাউফুন বসুনিয়া, কমরেড তাজুল, শাহাজাহান সিরাজ, জেহাদ, নুর হোসেন, ডা. মিলনরা আত্দাহুতি দেয়নি। গণতন্ত্রের রাজনীতিতে রাজপথের সংগ্রাম থেকে উঠে আসা যে খালেদা জিয়া ৯১ সালের নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন আজ তার ডাকা আন্দোলনে ৭১-এর পরাজিত রগকাটা রাজনীতির প্রবর্তক জামায়াত-শিবির দেশজুড়ে যে সহিংসতা চালিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই রাজনীতির দায় আজকের বিএনপিকে বহন করতে হচ্ছে।

৪.
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আজকের শাসক আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিল। রাজপথে গণজাগরণ ঘটিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করেছিল। সেই সব আন্দোলনেও রাজপথে পথচারী দিগম্বর করার ঘটনা ওই দলকে সমালোচিত করেছিল। কিন্তু বাসে-ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষের প্রাণহানি ঘটায়নি। দেশজুড়ে নাশকতা করেনি। করেনি বলেই গণজাগরণ ঘটিয়েছিল।

এদেশের রাজনীতিতে এরশাদ জমানা থেকে বিএনপি রাজপথের গণতান্ত্রিক দল। বিএনপি নেতা খালেদা জিয়ার হাত ধরে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে দেশ সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরেছিল। কিন্তু আজকের বিএনপির গলার কাঁটা জামায়াত-শিবির কলঙ্কের ঢোল হয়ে সারা দেশে বাজছে। আজকের আন্দোলন দেশ ও মানুষের বিরুদ্ধে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এই কর্মসূচির সুযোগে যে নাশকতা, সহিংসতা চলছে তা বিএনপির রাজনীতির চাকা পিছনের দিকে ঠেলে দেবে। বিএনপি সংসদ থেকে পদত্যাগ করে বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ গণঅবস্থান কর্মসূচি নিতে পারত দাবি আদায়ের জন্য। কিন্তু সেই পথ না নিয়ে আজ যে পথে হাঁটছে জামায়াত-শিবিরের হাত ধরে এই পথ কলঙ্কিত পথ। এই পথ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে স্বাধীনতা উত্তরকালে রোমান্টিক স্লোগাননির্ভর হটকারী জাসদ ও উগ্রপন্থি সর্বহারা পার্টি নিয়েছিল। এর পরিণতি ওইসব দলের জন্য যেমন সুখকর হয়নি, তেমনি দেশের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনেনি। ওই রাজনীতির অস্থির সময়ের পথ ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের খলনায়করা জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলাদেশের বুকে সামরিক শাসনের জগদ্বল পাথর চাপিয়ে দিয়েছিল। তার পরের ইতিহাস সবার জানা।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এই দেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য, স্বাধীকার-স্বাধীনতার জন্য গণমুখী কর্মসূচি নিয়ে শাসকের বুলেটে জীবন দিয়ে আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। গণমানুষের রাজনীতিতে সেদিন আন্দোলনকারীরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের গুলি খেয়েও পুলিশের ওপর পাল্টা গুলি ছোড়েনি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দৃশ্যপট আর হটকারী উগ্র সহিংস রাজনীতির দৃশ্যপট আলাদা। আজকের শাসকগোষ্ঠী যেমন একগুঁয়ে দমননীতির পথ নিয়েছে তেমনি বিরোধী দলও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বৃত্তের বাইরে গিয়ে উগ্র সহিংস রাজনীতির পথ নিয়েছে। রাজনীতি নিয়ে জুয়া খেলার এই পরিণতি শুভ নয়।

৫.
গতকাল বিকালে নিউজ টেবিলে বসে যখন টেলিভিশনে দেখলাম শাহবাগের কাছে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রল ঢেলে ১৮ জন মানুষকে অগি্নদগ্ধ করা হয়েছে বুকের ভেতরটা তখন যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। প্রতিদিন মানুষ মরছে। মানুষ বুক চাপড়ে কাঁদছে। তবুও ক্ষমতার জন্য মরিয়াপক্ষের দিলের মধ্যে রহম আসছে না। এই অমানবিক রাজনীতির বিরুদ্ধে জাগ্রত বিবেকের তাড়নায় আজ মানুষকেই দাঁড়াতে হবে। যারা মরছে, যারা আগুনে পুড়ছে, যারা ককটেল বোমায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে তারা মানুষ। তারা এই দেশের মানুষ। এই মানুষদের জীবনের আজ গ্যারান্টি চাই। এই অসুস্থ রাজনীতির প্রলয় থেকে মুক্তি চাই। এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে গণমানুষের ঐক্য চাই।

মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। পথে পথে রক্তপাত, পথে পথে অশ্রুপাত আর চাই না। এই অভিশপ্ত গণবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মহাপ্রলয় থেকে দেশ, মানুষ, গণতন্ত্র ও অর্থনীতি রক্ষায় পথে পথে প্রতিরোধ চাই।

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

পীর হাবিবুর রহমান: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশ সময়: ১০৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।