আগে খ্যাতিমান মানুষজনের নামের সঙ্গে বিশেষণ যুক্ত হত। ভালোবেসে মানুষ সেসব বিশেষণ দিত।
ছোটবেলায় আমাদের এলাকায় হাশেম চাচা ছিলেন। তাকে সবাই ডাকত ‘হ্যাজাক হাশেম’ বলে। রাতের বেলা হ্যাজাক জ্বালিয়ে গ্রাম পাহারা দিতেন কাশেম চাচা। একটু পর পর হাঁক দিতেন- হুঁশিয়ার।
হ্যাজাক হাশেম মানে চোর-ডাকাতের জম। তার আমলে গ্রামের ত্রিসীমানায় কোনও চোর-বাটপার ঘেঁষত না। ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ অবলম্বনে গ্রামের মুরুব্বিরা চাচার নাম দিয়েছিল ‘হ্যাজাক হাশেম’।
দিন বদলেছে। একই সাথে নামের বিশেষণ ঘুরতে ঘুরতে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেছে। ভালো বা বিখ্যাত মানুষ না। এখন সন্ত্রাসীদের নামের আগে বিশেষণ যুক্ত হয়। বিশেষণ ছাড়া আলোচিত সন্ত্রাসী খুব একটা নেই। যার যত খারাপ বিশেষণ সে তত বড় মাপের সন্ত্রাসী।
সন্ত্রাসীদের এই বিশেষণের শুরুটা হয়েছিল তাদের গায়ের রং এবং শরীরের বিশেষ কোনও খুঁতকে নামের সঙ্গে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে।
যেমন কালা জাহাঙ্গীর, কালা সেন্টু, পিচ্চি শামীম, কালা ফারুক, সাদা ফারুক, চিকনা বাবু, ধলা হিমেল, হাতকাটা রেকু।
শারীরিক খুঁতের মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়াদের মধ্যে আছে ট্যারা ছগির, নাককাটা রাসেল, ন্যাটা নাদের, বাইট্টা জালাল, চাকমা সুজন (দেখতে অনেকটা চাকমাদের মতো বলে এই বিশেষণ) কানা কাশেম, ছিলা ইকবাল। ছিলা ইকবালের শুরুর নাম ছিল ‘চান্দি ছিলা ইকবাল’। বলার সবিধার্থে কিছুদিনের মধ্যে সেটা শুধু ‘ছিলা ইকবাল’ এ পরিণত হয়।
এরপর বিশেষণ গেল বদঅভ্যাস আর মুদ্রাদোষের দিকে।
তোতলা গিয়াস, যক্ষা নাসির (সারাক্ষণ খুশ খুশ কাশত), হাঁপানি আসাদ, নখ কাঁটা সোহেল (দাঁত দিয়ে সারাক্ষণ নখ কাটত)।
এক বসায় পাঁচ-ছয় প্লেট ভাত খেত সন্ত্রাসী শাহীন। সেখান থেকে তার নাম হয়ে গেল ভেতো শাহীন। একই সময়ে একই নামে আরেক শাহীন ছিল। তার নাম ছিল পাউরুটি শাহীন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন নামের সাথে পাউরুটি যোগ হওয়ার কারণ।
পশু-পাখিও বাদ গেল না বিশেষণের হাত থেকে। প্রথমে গৃহপালিত। মুরগি মিলন, ডগ শিশির, ভেড়া সাগির, জালালি আশিষ। এই আশিষ সবসময় ঘাড়ে করে একটা জালালি কবুতর নিয়ে ঘুরত। সেজন্য তার নাম হয়ে যায় জালালি আশিষ। বিলাই রাসেলের চোখ ছিল ক্যাটস আই।
কুষ্টিয়ার দিকে এক সন্ত্রাসী ছিল ‘ঘোড়াশাহ’ নামে। ঘোড়ায় করে চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসী করত। গৃহপালিত পশু-পাখির পাশাপাশি বন্য পশুও যুক্ত হলো একসময়।
টাইগার বাবুল, সর্প বাবু, জাফর গন্ডার, বেজি রাসেল। এসবের পাশাপাশি অস্ত্রপাতি দিয়ে সন্ত্রাসীদের নামকরণও বেশ বাজার পায়। এদের মধ্যেও আবার দুটো ভাগ ছিল। দেশি অস্ত্র আর বিদেশি।
ড্যাগার বাবু, খুরচুন্নি বাবু, কুড়াল বাদশা, গদা শামীম, কসাই সালাম, ছোরা শামসু, রামদা জাকির। এরা হচ্ছে দেশি সংস্করণ।
ফরেন কোটায় ছিল বুলেট মানিক, ম্যাগজিন কাদের, বোমারু মিজান, এ কে আকাশ।
এ কে আকাশের ‘এ কে’ হচ্ছে এ কে ফোরটি সেভেনের এ কে। কথিত ছিল আকাশের কাছে একটি এ কে ফোরটি সেভেন ছিল। বিশাল ব্যাপার। সেজন্য তার এমন নামকরন। আবার ক্ষুদ্রার্থেও বিশেষন বসত। যেমন বীচি তুহিন। আন্ডার ওয়ার্ল্ডে গুলিকে বীচি বলে। তুহিন বীচি সরবরাহ করত। তাই তার নাম বীচি তুহিন।
দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে ভীন দেশের নামও অলংকার হয়েছে যুক্ত হয়েছে কারও কারও সাথে। সুইডেন আসলামকে তো অনেকেই চেনেন। আরও ছিল পানামা ফারুক, বেদুঈন কামরুল, জাপানি বাবু। প্যালেস্টাইন বাবু নামের এক সন্ত্রাসীও এক সময় বেশ আলোচিত ছিল।
আমাদের সময় ক্যাম্পাসে একজনের নাম ছিল ‘ভাঁপা দীপু’। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ভাঁপা পিঠার ভাঁপাই তার নামের আগে যুক্ত হয়েছে। ক্যাম্পাসে যারা পিঠা বিক্রি করত সবাই দীপুকে চাঁদা দিত। চাঁদা ছিল পাঁচ টাকা আর একটা করে ভাঁপা পিঠা। দীর্ঘদিন সে এই সাম্রাজ্য ধরে রেখেছিল। যে কারণে ক্যাম্পাসে একসময় তার নাম হয়ে যায় ‘ভাঁপা দীপু’।
মামা সেলিম নামে একজন ছিলেন। সেলিমের নামের আগে মামা বসার কারণ তার ভাগিনা তার আগেই সন্ত্রাসী হয়ে নাম কামিয়েছে। মামা যেহেতু পরে এসেছে তাই তার নাম হয়ে গেল মামা সেলিম।
আমাদের এলাকায় ছিল ‘ডিসকো ফয়সল’। আগে ডিসকোতে নাচত। সেখানে সুবিধা করতে না পেরে হয়েছে রংবাজ। সেখানে সফলতা পেয়েছে কিন্তু অতীতকে মুছে ফেলতে পারেনি। নামের সাথে ঠিকই ডিসকো লেগে গেছে।
যুগ বদলে যাচ্ছে। এখন প্রযুক্তি প্রাধান্য পাচ্ছে সবকিছুতে। সন্ত্রাসীদের বিশেষণের বেলায়ও হয়তো আগামীতে প্রযুক্তি ঢুকে পড়বে অবধারিতভাবে। কারণ প্রযুক্তির এই সময়ে প্রযুক্তিবান্ধব সন্ত্রাসীও নিশ্চয় চলে আসবে।
সামনেই হয়ত আমরা শুনতে পাবো আইফোন পিন্টু কিংবা স্যামসাং মন্টু নামের কোনও সন্ত্রাসীর নাম। আইফোন আর স্যামসাংয়ের মতো হয়ত কিছুদিন বাদে বাদে তাদের নতুন ভার্সনও পাওয়া যাবে।
এমনও হতে পারে কোনও সন্ত্রাসীর নাম হবে ‘ফোর এস ফখরুল’ কিংবা আপডেট আতাহার। টুইটার টগর কিংবা সফটওয়্যার সুমন নামে কোনও সন্ত্রাসীর অস্তিত্বও নিশ্চয়ই আমাদের অস্বস্তিতে ফেলবে না। ফেসবুকে চাঁদাবাঁজি করার কারণে কারও নাম হয়ে যেতে পারে ‘ফেবু ফাতেমি’।
কোনও কিছুই অসম্ভব না। কারণ সন্ত্রাসীদের নামে আগে শারিরিক গঠন-গাঠন, মুদ্রাদোষ আর অস্ত্রপাতির নামই বেশি যুক্ত হতো। বর্তমানে মসলাপাতিও ঢুকে পড়েছে। কয়েকদিন আগে এক সন্ত্রাসীর নাম শুনলাম ‘জিরা’ বাবুল।
কেন এ ধরণের ভেজিটেবল নামকরণ বুঝলাম না। তবে বুঝলাম, আমিষ থেকে সন্ত্রাসীরা এখন নিরামিষের মধ্যেও ঢুকে পড়ছে। আগামীতে আরও যে কোথায় যায়!
পলাশ মাহবুব : কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। প্রোগ্রাম ম্যানেজার, বৈশাখী টেলিভিশন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৪