ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গায়েবি নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন?

হাসান নাসির, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৪
গায়েবি নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন?

‘আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। নেতারা ভারতে পালিয়েছিলেন।

দেশের জনগণই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। শেখ মুজিব ছিলেন রাজাকার ও পাকবন্ধু। মুজিব বাহিনীই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। এত মানুষ হত্যার জন্য শেখ মুজিবই দায়ী। ’

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখন ইতিহাসবিদ। এই ভাষায় বক্তব্য রেখে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও কম যান না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- একাত্তরে যুদ্ধে যাওয়া সেই জনগণ কারা ছিল? তারা কোন্ দল করত? বিএনপি সমর্থক ছিলেন কি? তখনকার মানুষগুলোর নেতা কে ছিলেন? মাত্র কয়েকমাস আগেই তো সেই জনগণই ৯৮ শতাংশ ভোট দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অবিসংবাদিত নেতা বানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতারা যদি ভারতে পালিয়ে থেকে আমোদ ফূর্তিতে মেতে থাকেন, তবে ওই জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কারা। তবে কি গায়েবি নেতৃত্বে এদেশ স্বাধীন হয়েছে?

ভাবাই যায় না যে, একটি দেশ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে কোনো নেতা ছাড়াই! কথিত ইতিহাসবিদ এসব কী বলেন? তিনি কি এদেশের মানুষকে গাধা মনে করেন, নাকি নিজকে বেশি চালাক মনে করেন? লন্ডনে বসে বিএনপির এই নেতা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একের পর এক মনগড়া বক্তব্য রেখে চলেছেন। উদ্দেশ্য, এদেশের মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেওয়া। দুঃখজনক যে, এমন বক্তব্য বিশ্বাস করবার লোকের অভাবও এদেশে নেই।

বিএনপি নেতা তারেক রহমান আবারও বলেছেন, তার পিতা জিয়াউর রহমানই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক। জিয়ার নেতৃত্বেই নাকি দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু সেই জিয়া তো নেতা ছিলেন না।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদ তাঁর এক বইতে (সম্ভবত বইটির নাম ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’) বলেছেন, একটি দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা তিনিই দেবেন, যিনি দেশে-বিদেশে ওই আন্দোলনের নেতা হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের এই শব্দ সৈনিকের বক্তব্যের সূত্র ধরে বলতে পারি, জিয়াউর রহমান কোনো ঘোষণা দিলেও তা ঘোষণা হিসেবে বিবেচিত হবে না। জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো এখতিয়ারই ছিল না। মূল নেতা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বা তাজউদ্দিন আহমেদের স্বাধীনতা ঘোষণার এখতিয়ার ছিল। কিন্তু জিয়া কখনোই ঘোষক হতে পারেন না। সেই অধিকার তাঁর নেই। জিয়ার মুখ দিয়ে কিছু বলানোর সিদ্ধান্তটা ছিল রাজনৈতিক। উদ্দেশ্য, একজন আর্মি অফিসার দিয়ে কিছু বলিয়ে নিরস্ত্র জনগণের মনে সাহস যোগানো। পাক মিলিটারির চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করার সাহস দেখানোর জন্য জিয়ার যতটুকু সম্মান পাওয়া দরকার তা দেওয়া উচিত। এর বেশি নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মানে এদেশের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস। জিয়াউর রহমান বড়জোর হতে পারেন সেই ইতিহাসের একটি অনুচ্ছেদ মাত্র। এক বিএনপি নেতাকেই প্রশ্ন করেছিলাম- স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক মেজর রয়েছেন। আপনি নিজ আত্মীয়তার বাইরে তিনজন মেজরের নাম বলুন। তিনি বলতে পারেননি। বললাম, আপনারা কি এমন একজন মেজরের ঘোষণায় যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন? অপরিচিত কারো ডাকে কেউ সাড়া দেয় নাকি?

যে কোনো জাতির মুক্তিযুদ্ধ একটি দীর্ঘ আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। সে আন্দোলনের একজন নেতা থাকেন। ঘোষণা, আহবান আসবে ওই নেতার কাছ থেকে। অন্য কোনো কন্ঠ থেকে নয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করার এখতিয়ার শেখ হাসিনার। একইভাবে বিএনপির পক্ষে কোনো ঘোষণা দেয়ার অধিকার একমাত্র খালেদা জিয়ার। এর বাইরে কোনো আর্মি কিংবা পুলিশ অফিসার এমনকি একই ঘরানার কোনো আমলা বা বুদ্ধিজীবীর ঘোষণায় নিশ্চয়ই আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে উঠবে না।

বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা বড় বড় বিপ্লব ও স্বাধীনতা সংগ্রামের একেকজন প্রধান নেতাকে দেখতে পাই। সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়ক লেনিন, চীনে মাও সে তুং, ভিয়েতনামে হো চি মিন, কোরিয়ায় কিম ইল সুং, যুগোস্লাভিয়ায় মার্শাল টিটো, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত এবং কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো। এই নেতার জীবদ্দশায় নিশ্চয়ই ওই সব দেশে আরো অনেক নেতা ও কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু তাঁদের এড়িয়ে অন্য কোনো নেতা নায়ক হতে পেরেছেন কি? মূল নেতাকে বাইপাস করে অন্য কোনো নেতা ঘোষণা দিতে চাইলে সেটি গ্রহণযোগ্যতা পায় না। মূল নেতার বাইরে অন্য নেতারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতিও পান না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদি রাজাকার হয়ে থাকেন তাহলে এতদিন ধরে যাদের আমরা রাজাকার হিসেবে জেনে আসছি তারা কারা? মুজিব বাহিনী যদি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে থাকে তাহলে আল বদর-আল শামসদের ভূমিকা কি ছিল? মুজিব বাহিনী যদি বুদ্ধিজীবী হত্যা করে থাকে তবে তো তারা রাজাকার-আলবদরদেরই দোসর। তারেক জিয়া তার বক্তব্যে কি বোঝাতে চাইলেন? তবে কি তিনি রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার বানাতে চাইছেন?

জিয়াউর রহমান একদা দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতির ওপরে ক্ষমতাধর পদ নিশ্চয়ই এদেশে কোনোটাই নয়। কিন্তু তারপরও তিনি নিজেই এমন দাবি কখনোই করেননি। জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তা ভাবতে এখন মন সায় দেয় না। কারণ একজন মুক্তিযোদ্ধা মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে এতবড় একটি যুদ্ধের কথা ভুলে যেতে পারেন না। তিনি যদি মনেপ্রাণে মুক্তিযোদ্ধাই হয়ে থাকেন তবে রাজাকারদের মন্ত্রী এবং দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে ফিরিয়ে এনে রাজনীতি করার সুযোগ দিতেন না।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় এখন নিয়োজিত হয়েছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেই যোগ্যতা কিংবা মেধা তার আছে কিনা এ প্রশ্ন খোদ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও থাকা স্বাভাবিক মনে করি। বিএনপিতে অনেক প্রবীণ নেতা রয়েছেন, যারা এদেশের মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের ভূমিকাও দেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁরা তো এভাবে বলছেন না। মুক্তিযুদ্ধকালে আওয়ামী লীগের বাইরে অত্যন্ত সক্রিয় রাজনৈতিক দল ছিল ন্যাপ ও সিপিবি। তারাও কিন্তু নেতৃত্বের দাবি করছেন না। অথচ, যে বিএনপির জন্মই হয়েছে ১৯৭৮ সালে সেই বিএনপি দাবি করছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের। যদি সেই নেতাদের অনেকেই এখন বিএনপিতে থেকেও থাকেন, একাত্তর সালে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই ছিলেন। তাছাড়া তারেক রহমানের মুখে তার নানা-দাদার বয়সী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এমন কটূক্তি বড়ই অশোভন।  

জিয়াউর রহমান যদি মুক্তিযুদ্ধে কিছু ভূমিকা রেখে থাকেন বা তিনি যতটুকু ভূমিকা রেখেছেন সেটি অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য হওয়া উচিত। তাই বলে জিয়াকে দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর কাতারে নিয়ে যাবার বা বঙ্গবন্ধুর উপরে স্থান দেয়ার চেষ্টা এক ধরনের বেয়াদবি।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত জিয়াউর রহমানের বক্তব্যকে যদি আমলেও নিই, তাহলেও সেটি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে না। কারণ, জিয়া ঘোষণা দিয়েছিলেন একাত্তর সালের ২৭ মার্চ, যা প্রচারিত হবার কথা পরদিন ২৮ মার্চের পত্রিকায়। কিন্তু ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকাসহ মহাদেশগুলোর অন্তত ২৫টি পত্রিকায় ২৬ মার্চ তারিখেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবরটি তাঁর ছবিসহ প্রধান খবর হয়েছে।   বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে গুগল ও ইউটিউব সার্চ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত ১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চের পত্রিকাগুলো অতি সহজেই দেখে নেয়া যায়।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য শুনে মনে হয়-তিনি হয় তো এখন মনে মনে বলছেন- ‘হায় পিতা, তুমি নিজেই জানতে না যে, তুমিই ছিলে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক, ঘোষক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি। তোমার আর বলার সুযোগ নেই।
 কারণ, তুমি প্রয়াত। এখন আমরা নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে বের করতে সক্ষম হয়েছি যে, তুমিই জাতির পিতা। কিন্তু তুমি বেঁচে থেকে এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকেও তা জেনে যেতে পারলে না। হায়-আফসোস!’

কোনো মৃত ব্যক্তির লাশ পাওয়া না গেলে তার গায়েবানা জানাজা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রের জন্ম হলো রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মাধ্যমে। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও সেই যুদ্ধের নেতা খুঁজে পাচ্ছেন না বিএনপির এই নেতা। তবে কি এমন একটি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ছিল গায়েবি? 

হাসান নাসির: সাংবাদিক ও লেখক

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।