ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিস্মৃতপ্রায় হোসেনী ব্রাহ্মণ ঐতিহ্য ও কিংবদন্তি

ড. গোলাম সারওয়ার  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০২১
বিস্মৃতপ্রায় হোসেনী ব্রাহ্মণ ঐতিহ্য ও কিংবদন্তি কারবালার ময়দানে ইমাম হোসেনের সঙ্গে হোসেনী ব্রাহ্মণরা। প্রতীকী ছবি

হোসেনী ব্রাহ্মণগণ হলেন মোহ্যাল সম্প্রদায়ের। মোহ্যাল সম্প্রদায় হিন্দু ও ইসলাম উভয়ের মঙ্গে সম্পর্কিত।

মোহ্যাল সম্প্রদায় এসেছে সরস্বত ব্রাহ্মণ থেকে। সরস্বত ব্রাহ্মণ নামটি এসেছে প্রাচীন সরস্বতী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করত বলে। ঋগ্বেদে সরস্বতী নদীকে উত্তর-পশ্চিম ভারতের পবিত্র নদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।  

সরস্বতী নদী প্রাচীন গান্ধার (আফগানিস্তান) রাজ্যের হিন্দুকুশ পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই নদীর অববাহিকা আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তানের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত। উত্তর-পশ্চিম ভারত হলো সরস্বত ব্রাহ্মণদের আদি নিবাস। সরস্বত সম্প্রদায়ের একটি শাখা হলো মোহ্যাল ব্রাহ্মণ। আবার মোহ্যাল সম্প্রদায় সাতটি উপবিভাগে বিভক্ত বালি, ভিমাল, চিবর, দত্ত, লেউ, মোহন ও ভেদ।  

সনাতন হিন্দু শাস্ত্র মতে ব্রাহ্মণদের কাজ যজ্ঞ, উপাসনা, পৌরহিত্য ইত্যাদিতে আবদ্ধ থাকলেও ‘দত্ত’ ব্রাহ্মণদের ইতিহাস কিছুটা ব্যক্তিক্রম। দত্তরা হলেন এই মোহ্যাল গোষ্ঠীর অন্যতম যোদ্ধা বংশীয় ব্রাহ্মণ। তারা একই সঙ্গে হোসেনী ব্রাহ্মণ নামেও পরিচিত। রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাবে বেশ কিছু হোসেনী ব্রাহ্মণ বাস করেন।  

ঐতিহাসিক তথ্যে দাবি করা হয়েছে যে, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত কারবালার যুদ্ধের সময় বাগদাদে ১ হাজার ৪০০টি ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করতেন। তারা কারবালার যুদ্ধে হযরত আলীর পুত্র ইমাম হোসেনের পক্ষে মুয়াবিয়া পুত্র এজিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছেন।  

ধারণা করা হয়, এই পরিবারগুলোই আদি হোসেনী ব্রাহ্মণ। ৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে তারা ভারতে এসে শিয়ালকোটের দিনানগর ও রাজস্থানের পুষ্করে বসতি স্থাপন করেন।  

হোসেনী ব্রাহ্মণ সম্পর্কে বিভিন্ন কিংবদন্তীর মধ্যে এটিও বর্ণিত হয়েছে যে, সন্তানহীন রাহাব দত্ত ব্যক্তিগতভাবে হোসেন ইবনে আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সন্তান লাভের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তার ইচ্ছার প্রতিক্রিয়া তাকে জানাল যে, তার ভাগ্যে কোনো সন্তান নেই। রাহাব দত্তকে জানানো হলো যে, তিনি পুত্রের পিতা হতে পারবেন না। তা জানার পরে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং কষ্টে কাঁদতে লাগলেন। দত্ত সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে ইমাম হোসেনকে অনুরোধ করতে বললেন। এ সময়ে ইমাম হোসেন তাকে জানান যে, তিনি পুত্র সন্তান লাভ করবেন। ইমাম হোসেন দত্তকে সাত সন্তান জন্মের সুসংবাদ দিয়েছিলেন।  

হোসেনী ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষ ছিলেন রাহাব দত্ত। তিনি তার অনুসারী ও সন্তানদের নিয়ে ইমাম হোসেনের জন্য এজিদের বিরুদ্ধে কারবালার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধে তার সাত সন্তান নিহত হয়। রাহাব দত্ত পরবর্তীতে ভারতে ফিরে আসেন এবং তার নামের সঙ্গে হোসেনী শব্দ যুক্ত করে নেন। এসময়কালের প্রায় ৫০০ দত্ত ব্রাহ্মণ তাদের পূর্ব ইতিহাসের অংশ হিসেবে ইমাম হোসেনের নামের ‘হোসেন’ অংশটি নিজেদের উপাধি করে নেন এবং নিজেদের ‘হোসেনী ব্রাহ্মণ’ নামে পরিচয় দিতে শুরু করেন।  

এই হোসেনী ব্রাহ্মণদের উত্তরসূরী বলিউডের খ্যাতিমান নায়ক সুনাল দত্ত লাহোরে শওকত খানুম হাসপাতালের জন্য অর্থদান করার সময় বলেন,  ‘For Lahore, like my elders, I will shed every drop of blood and give any donation asked for, just as my ancestors did when they laid down their lives for Karbala for Hazrat Imam Husain.’ 

হোসেনী ব্রাহ্মণরা মনে করেন, রাহাব দত্তের সঙ্গে ইমাম হোসেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং আরবে তিনি বেশ সম্মানিত ছিলেন। কারবালার যুদ্ধে তার সাত পুত্র জীবন উৎসর্গ করেন। তারা হলেন পেরো, রাম সিং, হারাস সিং, রাই পান, সাহাস রাই, শের খান, ধারো।  

১০ মহরম ৬১ হিজরিতে সংঘটিত কারবালার যুদ্ধে ইমাম হোসেনসহ নবী পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন। দত্ত ব্রাহ্মণরা ও ইমাম হোসেনের অনুসারীরা কারবালার পরেও যুদ্ধ ত্যাগ করেনি। সাহসী হোসেনী ব্রাহ্মণ একাত্ম হন আমীর আল মোখতারের নেতৃত্বে। তারা কুফার দুর্গ আক্রমণ করেন। এজিদের গভর্নর ওবাইদুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পরবর্তীতে উমাইয়া প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে রাহাব দত্ত সাতপুত্র হারানোর শোকে আফগানিস্তানে চলে আসেন। অন্যান্য দত্ত ব্রাহ্মণরাও শিয়ালকোট, রাজস্থানের পুষ্কর প্রভৃতি স্থানে চলে যান। হোসেনী ব্রাহ্মণদের অনেকই এখন দত্ত, শর্মা, ভরদ্বাজ ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার করেন।  

মুসলমানদের অন্যতম তীর্থস্থান হলো রাজস্থানের আজমীর। এখানে সুফি সাধক খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী বসবাস করতেন এবং শেষকাল অতিবাহিত করেছিলেন। আজমীরে এমন একটি শ্রেণি রয়েছে যারা নিজেদেরকে হোসেনী ব্রাহ্মণ হিসেবে দাবি করেন। হোসেনী ব্রাহ্মণরা হিন্দুধর্ম ও ইসলামী ঐতিহ্যের মিশ্রণ অনুশীলন করে থাকে। একটি জনপ্রিয় ভাষ্যে হোসেনী ব্রাহ্মণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ওয়াহ দত্ত সুলতান, হিন্দু বা ধার্ম, মুসলমান কা ঈমান, আধা হিন্দু আধা মুসলমান। অর্থাৎ ভালো দত্ত সুলতান, হিন্দুর ধর্ম ও মুসলমানের বিশ্বাস, অর্ধ হিন্দু এবং অর্ধ মুসলমান।  

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ মুজিব হোসেনী ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে বলেন, ‘The (Hussain Brahmins) were not really converts to Islam, but adopted such Islamic beliefs and practices as were not deemed contrary to the Hindu faith.’

এখনও হোসেনী ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলেদের মাথা মুণ্ডনের সময় ইমাম হোসেনের নাম উচ্চারণ করা হয় এবং বিবাহ অনুষ্ঠানে ইমাম হোসেনের স্মরণে হলুয়া রান্না করে বিবরণ করা হয়। সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের দিকে হোসেনী ব্রাহ্মণরা গুজরাট সিন্ধু, পাঞ্চাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল।  

মহারাজা রণজিত সিং এর সময়কালে অমৃতসর শহরে উল্লেখযোগ্য হোসেনী ব্রাহ্মণদের বসতি গড়ে উঠেছিল। ১৯৪০ এর দশকে হোসেনী ব্রাহ্মণরা অবশ্য পালনীয়ভাবে মহরমের শোক পালনে অংশগ্রহণ করতেন। ইতিহাসবিদ ননিকা দত্ত উল্লেখ করেছেন যে, পার্টিশন পূর্ব সময়কালে আমৃতসর শহরে শিয়া মুসলিম ও হোসেনী ব্রাহ্মণরা এক সঙ্গেই ইমামবাড়াগুলোর তত্ত্বাবধান করতেন এবং একই সঙ্গে মহরমের তাজিয়াতে অংশগ্রহণ করতেন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে হোসেনী ব্রাহ্মণরাও দুটি দেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানে তারা অমুসলিম হিসেবে এবং ভারতে মুসলমানদের কাছাকাছি হিসেবে চিহ্নিত হন। অমৃতসর-সহ বিভিন্ন স্থানে তারা হিন্দু উগ্রবাদীদের হয়রানির শিকার হন। এসময় পূর্বপাঞ্চাবের কোথাও মহরমের জুলুস বের হয়নি। তেমনিভাবে লাহোর শিয়ালকোট এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও তারা মুসলিম উগ্রবাদীর দ্বারা নিগৃহীত হয়ে ভারতে চলে আসতে থাকেন।  

হোসেনী ব্রাহ্মণদের গলায় একটি চিহ্ন দেখা যায়। এই চিহ্নটি খুব ছোট আকারের হয়। তারা মনে করেন কারবালার ত্যাগের অন্যতম প্রমাণ হলো এই চিহ্ন। পরিবারের যেকোনো উৎসবে ঈশ্বরকে তারপর ইমাম হোসেনকে স্মরণ করে তারা কাজ আরম্ভ করেন।  

বর্তমানে ভারতে প্রায় পাঁচ লাখ এই সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। তাদের বিখ্যাতদের মধ্যে রয়েছেন অভিনেতা সুনীল দত্ত, সঞ্জয় দত্ত, উর্দু কবি কাশ্মীরী লাল জাকির, নন্দ কিশোর বিক্রম প্রমুখ।  

সময়ের স্রোতে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার স্রোত হয়েছে শক্তিশালী। আর সুন্নী মুসলিমদের বৃহত্তর অংশ আশুরা পালনকে মনে করেন বেদাত বা ধর্মপরিপন্থী। অন্যদিকে আরএসএস বজরংদল প্রভৃতি মৌলবাদী হিন্দুদের চোখেও হোসেনী ব্রাহ্মণরা খাঁটি হিন্দু নন। এর সঙ্গে গ্লোবালাইজেশন-করপোরেটের জামানায় ব্যস্ত সমাজ ক্রমেই হারাচ্ছে পুরাতন ঐতিহ্য। এসবের ধক্কায় সমন্বয়ধর্মী হোসেনী ব্রাহ্মণ ঐতিহ্য অনেকটাই হুমকির সম্মুখীন।  

হোসেনী ব্রাহ্মণদের উত্তরসূরী ইতিহাসবিদ ননিকা দত্তের ভাষায়, ‘The reality is that the community, whose ancestors are believed to have sacrificed their seven sons Imam Husain, has migrated to different parts of the world as global citizens. Many have simply discarded their Hussaini Brahmin identity and started to represent themselves as “Brahmins” a construct that is miles away what the community originally represented.’ 

উপমহাদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে নানা কিংবদন্তী। রাহাব দত্ত ও তার সন্তানদের আত্মত্যাগের আখ্যান বস্তুনিষ্ঠ কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারতবর্ষে শত শত বছর ধরে সমন্বয়ধর্মী হোসেনী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় টিকে আছে তা অবশ্যই বাস্তব। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সাম্প্রদায়িক পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে হোসেনপন্থী এই চিন্তা অবশ্যই শক্তি যোগাবে, মহরমের শেষ পাদে এই চাওয়া নিশ্চয় অমূলক নয়।  

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়  

তথ্যসূত্র:
1.     Nonica Datta (September 30, 2019). "The Forgotten History of Hussaini Brahmins and Muharram in Amritsar". The Wire (Indian News and Opinion Website). 
2.     Shafaqna (October 15, 2016). "Who are the Hussaini Brahmins? What part did they play in the Battle of Karbala". Shafaqna (Shia International News Association). 
3.     NADEEM INAMDAR, RIZWAN KHAN. "Brahmins who went to war for the Imam". Times group, India. The Times of India.
4.     Akram, Maria (5 November 2014). "For Hussaini brahmans, it's Muharram as usual". Times group, India. The Times of India..
5.     Zeba T Hashmi (March 17, 2015). "Ashura and pluralism". Daily Times, Pakistan..
6.    Abul Fazl (November 5, 2014). "The Brahmins Who Fought For Imam Hussain At Karbala". Kashmir Observer Online. 
7.     Mohyals, Muslims and Mustafabad". The Tribune, Chandigarh. 8 August 1993
8.      Mahdi Nazmi (1984). Reg-i-Surkh: Dut Brahman Imam Husain se Rabt o Zabt. Abu Talib Academy, New Delhi. pp. 63–71.
9.     Mitra, Sisir Kumar. The Vision of India. Bombay, India: Jaico Publishing House. pp. 229–230 (First Print 1949).
10.    "Hussaini Brahmans: A historic bondage between Hindus and Shias". News Bharati English. 9 August 2013..
11.    Sheik, Majid (26 November 2012). "Karbala and how Lahore was involved". Dawn. Dawn News Paper, Lahore.
12.     Hussaini Brahmins Hindus who celebrate muharram, Indian Express
13.    Brahmins Fought for Imam Hussain in the Battle of Karbala
http://hussainibrahmin.tumblr.com/brahminsinkarbala
14.    Dawn, Nov. 2012 (Karbala and Lahore was involved https://www.down.com>news>kar...)

বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২১
জেএইচটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।