রাজনীতির মোকাবিলা করতে হয় রাজনীতি দিয়ে। দীর্ঘমেয়াদে অপরাজনীতি ভর করলে সর্বনাশ হয়ে যায় সুস্থধারার।
মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নতুন করে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। দেশ-বিদেশে সামাজিক মাধ্যমে কটাক্ষ, মিথ্যাচার, কুৎসা রটানো হচ্ছে। সাইবার সন্ত্রাসীদের ভাড়া করেছে চক্রান্তকারীরা। ব্যাপক অর্থ ব্যয় করছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। কাজগুলো করছে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে। বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের ছাড় দিচ্ছে না। সরকারকে অসহায় মনে হয়। ভাবখানা এমন, কারও কিছু করার নেই। মন্ত্রী সাহেবদের অসহায়ত্ব দেখলে মনটা বিষাদে ছেয়ে যায়। তারা পারছেন না সাইবার সন্ত্রাস দমন করতে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সমালোচনা অবশ্যই করতে পারে যে কেউ। ক্ষমতাসীন সরকারের ভুল তুলে ধরতেও পারে। কিন্তু জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে নোংরামি দেখে সংশ্লিষ্ট মাননীয়রা ঘুমান কেমন করে? কেন কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেন না? রাষ্ট্র কখনো দুর্বল হতে পারে না। ক্ষমতাবান একজন ব্যক্তি হতে পারেন। রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ অবস্থান ও পদে থেকে দয়া করে অসহায়ত্ব প্রকাশ করবেন না। ঘোষণা দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতার কথা জানাবেন না জাতিকে। না পারলে নিজ থেকে সরে পড়ুন দায়িত্ব থেকে। সাইবার সন্ত্রাস নিয়ে কঠোর হোন। আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই টার্গেট করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী পরিবারকে। বসে থাকার সুযোগ নেই। ঘুমপাড়ানি গান শোনার সময় নেই। বিষফোঁড়া নিয়ে চলা যায় না। বেলা বয়ে গেলে অন্ধকার নেমে আসে। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। না হলে পরে খেসারত দিতে হয়।
শরীরের ক্ষত দূর করা যায় চিকিৎসা করে। মনের ক্ষত কোনোভাবে সারানো যায় না। একবার মনের অসুখ ভর করলে কোনো ডাক্তার-কবিরাজ কাজে লাগে না। এক জীবনে মানুষের কত ধরনের দুঃখ লুকিয়ে থাকে। সব কথা বলা যায় না কাউকেই। অনেক কিছুই লুকিয়ে রাখতে হয় বুকের ভেতরে। করোনাকালে অনেক বন্ধু, প্রিয়জন, শুভানুধ্যায়ীকে হারিয়েছি। চলে গেছেন হুট করে। মৃত্যু এখন স্বাভাবিক বিষয়। মৃত্যুর খবর কাউকে ব্যথিত করে না। প্রিয়জনের মৃত্যু কাউকে আঘাত করে না। এমনও দেখেছি, সন্তানের মৃত্যুশোক না কাটতেই ব্যস্ত হয়েছেন অন্যের বিরুদ্ধে ফেসবুকে মিথ্যা কুৎসা রটাতে। নাজিম হিকমত ঠিকই লিখেছেন, বিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর। বাস্তবে এখন এক দিনও না। জানাজা পড়তে গিয়ে ভালো খাওয়া-দাওয়ার গল্প হয়। শোক কাটাতে চেহলামে গরু জবাই করে খাওয়ার উৎসব হয়। মৃত মানুষের আত্মার শান্তি কামনা এবং শোক শেষ হয়ে যায় উৎসবী পরিবেশে। জগৎ সংসার বড় অদ্ভুত। মানুষের মন বদলে যাচ্ছে। প্রযুক্তি কেড়ে নিচ্ছে আবেগ। যতক্ষণ ক্ষমতা ততক্ষণ পূজা। ক্ষমতাহারা বন্ধুর পাশে কেউ দাঁড়ায় না। কেউ থাকে না। অসহায় মানুষকে উপেক্ষা করে সবাই। পোশাক দেখে আদর আপ্যায়নের বর্ণনা শেখ সাদি দিয়ে গেছেন। এখনো ক্ষমতা ও অবস্থান দেখে হয় মূল্যায়ন। নোংরামি, হিংসা, মিথ্যাচার ভর করেছে সবখানে। ঈর্ষাকাতর মুখগুলো ব্যস্ত থাকে অন্যের সর্বনাশা চিন্তায়। পুত্রশোক না করে কুৎসা রটায়। অসুস্থ সমাজে কীভাবে বাস করবে স্বাভাবিক মানুষ? নিজের ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের ওপর চাপিয়ে দীর্ঘ সময় টিকে থাকা যায় না। টিকে থাকলেও শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুর পরিণামই ভালো হয় না। হাশরের ময়দানে কেউ কারও নয়। ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি। যার যার হিসাব তাকেই দিতে হবে। ধর্ম তা-ই বলে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, ক্ষমতা হারানোর পর মানুষের চেহারা মুহূর্তে বদলে যায়। আনুকূল্য নিতে যারা বেশি তোষামোদী করে তারা বদলায় সবার আগে। ক্ষমতার আপনজনরা আপন হন না। দুঃসময়ের মানুষ আলাদা। ২০১০ সালের পর এরশাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে আড্ডা দিয়েছি। গল্পগুজবে রাজনীতি, ক্ষমতায় থাকা, সবকিছু হারানো, কারাজীবনসহ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও তাঁর কথা শুনতাম। এরশাদ সাহেব অনেক সুখ-দুঃখও শেয়ার করতেন। বাদ থাকত না রাজনীতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত অন্দরমহলের কথা। সেনাপ্রধান থেকে সামরিক আইন প্রশাসক, প্রেসিডেন্ট থেকে ক্ষমতার পতন, কারাগারের দুঃসহ জীবন- অনেক কিছুই বলেছেন। একবার তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর আমলে ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের নিয়ে কোনো দুঃখবোধ জাগে কি না? তিনি বললেন, ‘অবশ্যই জাগে। তবে আমার নয় বছরে আন্দোলন-সংগ্রামে কতজন মানুষ মারা গেছে হিসাব-নিকাশ কর। পরবর্তী সরকারগুলোর মেয়াদের ঘটনাগুলোরও তালিকা কর। তারপর বিচার-বিশ্লেষণে আস। একতরফা মূল্যায়নে দেখা হয়েছে আমাকে। বিশেষ করে তোমরা সাংবাদিকরা আমাকে সব সময় খুনি বলেছ। মনে রেখ, আমার হাতে রক্তের দাগ নেই। আর দাগ নেই বলেই তোমার সামনে বসে আছি। আড্ডা দিচ্ছি। বিশ্বে আমি একমাত্র সামরিক স্বৈরশাসক ক্ষমতা ছাড়ার পর স্বাভাবিক জীবনে আছি। টানা ভোটে জয়ী হয়েছি। মানুষ ভোট দিয়েছে। এমনকি ১৯৯১ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পরও কারাগারে থেকে পাঁচটি আসনে জয়ী হয়েছি। এর চেয়ে বেশি আসনে ভোট করার প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়েছিল আইন করে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এক হয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরেছে শুধু রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার থাকলে ভোট হলে জয়ী হতাম বলে। ছাত্রদের আন্দোলনে নয়, ক্ষমতা ছেড়েছি সেনাপ্রধান বিট্রে করার কারণে। আতিককে আরও এক বছর রাখলে ইতিহাস ভিন্ন হতো। ’
আলোচনা সিরিয়াস দিকে চলে যাচ্ছিল। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বললাম, আপনি হলেন বিশ্বের তাক লাগানো প্রেমিকপুরুষ। কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেননি। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রেম করেছেন। বিরোধী দলে এসেও থেমে নেই। এখনো তরুণীরা আপনার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। তাদের নিয়ে ভালো আছেন। এরশাদ সাহেব হাসলেন। বাসার কাজের সহযোগী ওয়াবকে ডাকলেন। খাবার দিতে বললেন। বিদিশাপুত্র এরিক ছিল বাসায়। একটু পর এসে বলল, সাথী আপা কি চলে যাবে? আমি বললাম, সাথীটা কে? এরশাদ সাহেব কিছু বললেন না। এরিককে সরানোর চেষ্টা করলেন। এরিক আবার প্রশ্ন করল। ওয়াব এসে চা-নাশতা রাখল। এরশাদ সাহেব ভেতরে গেলেন। ফিরে এলেন। বুঝলাম কাউকে বিদায় করে এসেছেন। আমি আবার বললাম, আপনি প্রেমিক হিসেবে কতটা সফল? তিনি বললেন, ‘তুমি সব সময় দুষ্টুমি কর। ’ তারপর বললেন, ‘আমার হাতে গোলাপ আছে। মানুষকে ভালোবেসেছি। ভালোবাসায় কোনো অন্যায় নেই। আমাকেও মানুষ ভালোবাসে। ’ তিনি রংপুরের মানুষের প্রশংসা করেন। বললেন, ‘তাদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। রংপুরের সন্তান হিসেবে দুঃসময়ে তাদের ভালোবাসা পেয়েছি। ’ তিনি হঠাৎ করেই রওশন এরশাদের অনেক প্রশংসা করলেন। বললেন, ‘এই নারী সব সুখে-দুঃখে ছিলেন, আছেন। তাঁর বিষয়টি আমার কাছে সম্পূর্ণ আলাদা। ’ রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। বললেন ভাই জি এম কাদেরের কথা। বললেন, ‘আমার ভাইটা ভালো মানুষ। ’ ক্ষমতায় থাকাকালে জি এম কাদের উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। নিজের ভাইয়ের বদনাম হয় এমন কিছু করেননি। জি এম কাদেরের প্রতি এরশাদের স্নেহটা ছিল আলাদা রকম। নানামুখী আলোচনায় বললাম, এক মেয়ে নাকি আপনাকে রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেছে? এটা কি রক্ত না লাল রং। তিনি আবার হাসলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি এত খবর কই পাও?অন্দরমহলের খবরও বাদ থাকে না তোমার কাছে!’ তারপর লাইব্রেরিরুমে গেলেন। অনেক চিঠি নিয়ে ফিরলেন। একটি চিঠির কালি লাল। চিঠিটি হাতে নিলাম। তিনি বললেন, ‘দেখ। আবেগাপ্লুত কোনো তরুণীর লেখা চিঠি। ’ বুঝলাম ঢাকার বাইরে থেকে পাঠানো। রক্ত না রং নিজেই কনফিউজড হলাম। বললাম, বুঝতে পারছি না কী দিয়ে লেখা চিঠি। রক্ত শুধু মানুষের হয় না। প্রাণীর রক্তের রংও লাল হয়। তিনি কথা বাড়ালেন না। হাসলেন। তারপর চিঠিগুলো নিয়ে আবার ভিতরে গেলেন। যত্ন করে রেখে এলেন।
প্রেমপত্রের যুগ শেষ হয়ে গেছে। এখন হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জারের যুগ। প্রেমিক-প্রেমিকরা সরাসরি কথা বলেন। কোনো রাখঢাক নেই। কষ্ট করে আবেগ নিয়ে গল্পে, কবিতায় চিঠি লেখারও দরকার নেই। পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথনের মতো বই এখনকার প্রজন্ম পড়ে না। সুনীলের ‘নীরা’ তাদের আলোড়িত করে না। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ পড়ার প্রয়োজন মনে করে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এখন অনেক সহজ ব্যবস্থা দিয়েছে যোগাযোগের। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি সচিত্র প্রেমপত্র, স্বামী-স্ত্রীর চিঠি চালাচালির বই বিক্রি হতো রেলস্টেশনের বইয়ের স্টলে। আবার ফুটপাথের দোকানেও পাওয়া যেত। এখন সেসব দিন নেই। প্রযুক্তি বিশ্বকে মুহূর্তে কাছে টানছে। কিন্তু মানুষের আবেগকে সৃষ্টিশীলতার রূপ দিতে পারছে না। আর পারছে না বলেই চিন্তার প্রখরতা কমে যাচ্ছে। মানুষ খুব সহজে বিশ্বাস করছে অসুস্থতা, মিথ্যাচার, নোংরামি আর গুজব। মানুষ এখন আবেগশূন্য। সামাজিক নৈতিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ একটা সময় চলছে। আজকাল মানুষের সঙ্গে মিশতে ভয় লাগে। ছোট্ট একটা জীবন। এত জটিলতা ভালো লাগে না। স্বপ্নের মোহময় ভুবনে কখনো কখনো একাকিত্বই ভালো।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১
এএটি