মানুষের উপকার করতেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। ব্রিটিশ শাসনকালে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে ছিলেন শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
আমাদের ভূখন্ডের মানুষকে শেরেবাংলা ভালো করেই চিনেছিলেন। ইতিহাসের পরতে পরতে বিশ্বাসঘাতকরা লুকিয়ে আছে। বেইমান, মীরজাফর, খন্দকার মোশতাকরা ঘুরে বেড়ায় আমাদের চারপাশে। ইতিহাসে নায়ক থাকে, খলনায়কও থাকে। সব চরিত্রের অধ্যায়, অবস্থান আলাদা করে নির্ধারণ করা। মীরমদন, মোহনলালের অবস্থান বীরত্বে। আবার মীরজাফর, উমিচাঁদ, ঘষেটি বেগমদের অবস্থান মুনাফেকিতে। বিশ্বাসঘাতকদের কারণে প্রাণ দিয়েছেন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ ধরা পড়েন মানুষের ওপর আস্থা রেখে। বাহাদুর শাহকে ইংরেজ বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেন তাঁকে আশ্রয়দানকারী মাজারের খাদেম। আটকের পর শেষ মুহুর্তে বাহাদুর শাহ একবার তাকিয়েছিলেন খাদেমের দিকে। অর্থলোভী খাদেমের মাথাটা নিচুই ছিল। বৃদ্ধ সম্রাট হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বুঝতে এবং হজম করতে সময় লেগেছিল। যখন সব বুঝলেন তখন হাঁটতে থাকেন ইংরেজ বেনিয়া সেনাদের সঙ্গে অজানার পথে। ইতিহাস কোনো দিন খুনি বিশ্বাসঘাতককে ঠাঁই দেয় না। সাময়িক ফায়দা দেয়। কিন্তু বেশিদিন তা স্থায়ী হয় না। মীরজাফর, মোশতাকরা কত দিন ক্ষমতায় ছিলেন পুতুল সরকার হিসেবে? বেশিদিন না। অল্প সময়ে বিদায় নিতে হয়েছিল নিষ্ঠুরভাবে। মীরজাফর, ঘষেটি বেগম, খন্দকার মোশতাকদের ইতিহাসে এখন অবস্থান গালি হিসেবে। ষড়যন্ত্রকারীরা টিকতে পারে না। মানুষ সব জানে। তার পরও লোভে পড়ে মোশতাক হয়, মীরজাফর হয়। বিশ্বাস, আস্থা, সমাজ ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে। এভাবে চলে আসছে আমাদের ভূখন্ডে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাসই করতেন না তাঁকে কোনো বাঙালি খুন করতে পারে। এসবির ডিআইজি ই এ চৌধুরীর কাছে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে বারবার নেতিবাচক খবর আসতে থাকে। একাধিক রাত তিনি পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেন। একপর্যায়ে বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। একা না গিয়ে রক্ষীবাহিনীর দুই উপপরিচালক আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার হোসেন মোল্লাকে নিয়ে একদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন। সরোয়ার মোল্লা আমাকে বলেছেন, তাদের সঙ্গে ছিলেন রক্ষীবাহিনীর আরেকজন কর্মকর্তা কর্নেল সাবিহ উদ্দিন। তিনজন বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে না থাকতে। দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য ধানমন্ডি ৩২ নিরাপদ স্থান নয়। সাবিহ উদ্দিন একটি বই নিয়ে যান। বইটির নাম ‘অ্যা ম্যান অন দ্য হর্স ব্যাক’। এ বইতে দুনিয়ার শতাধিক সামরিক ক্যুর কথা লেখা ছিল। অল্প কিছু মানুষ কীভাবে ক্যু করে তার বর্ণনাও ছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করলেন গণভবনে থাকতে। বঙ্গবন্ধুর নেতিবাচক ভাব দেখে ই এ চৌধুরী বঙ্গভবনে থাকতেও বলেছেন। বঙ্গবন্ধু তাদের কথা শুনলেন। তারপর বললেন, বাংলার মানুষ আমাকে মারবে! তারপর বললেন, তোমরা তোমাদের রক্ষীবাহিনী চালাও। আইনশৃঙ্খলা ঠিক কর। দেশের মানুষের শান্তি নিশ্চিত কর। শুধু রক্ষীবাহিনী নয়, বঙ্গবন্ধুকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সতর্ক করে। ইন্দিরা গান্ধী ‘র’-প্রধানকে পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের কথাকেও গুরুত্ব দেননি। পাত্তা দেননি। এমনকি মৃত্যুর আগেও সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে খুনিদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, পাকিস্তান আর্মি আমাকে হত্যার সাহস পায়নি। তোরা কারা? কী চাস? বঙ্গবন্ধু ভাবতেন কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে না। পারবে না। কারণ এই বাঙালিকে তিনি একটি দেশ দিয়েছেন। বিশে^র বুকে একটি পাসপোর্ট দিয়েছেন। কীভাবে তারা তাঁর বিরুদ্ধে যাবে!
বঙ্গবন্ধু ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পরই ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক এ এল খতিবের ‘হু কিল্ড মুজিব’ বইতে অনেক কিছু লেখা আছে। অনেক অজানা ষড়যন্ত্রের বর্ণনা আছে। ’৭২ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েন। গলব্লাডার স্টোন অপারেশনের জন্য লন্ডন যান। ১১ আগস্ট হলিডে পত্রিকায় লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিনের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণ করা হয়। সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়। জিয়াউদ্দিন ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। এভাবে একজন কর্মকর্তার লেখা প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক সেনা আইনে কোর্ট মার্শাল হওয়ার কথা ছিল। ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কেউ ব্যবস্থা নিলেন না। সবাই তাকিয়ে ছিলেন একজনের দিকে। বঙ্গবন্ধু লন্ডনে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কোনো সিদ্ধান্ত দিলেন না। কর্নেল তাহেরের ঘনিষ্ঠ এই সেনা কর্মকর্তা বামধারার চিন্তা করতেন। লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন লে. কর্নেল জিয়া। বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, ক্ষমা চাইলে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হবে না। বঙ্গবন্ধুর এ উদারতা তখনকার সেনা কর্মকর্তাদের অনেককে বিস্মিত করে। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বের হয়ে পালিয়ে যান জিয়াউদ্দিন। তারপর যোগ দেন সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টিতে। সর্বহারা পার্টির তখনকার গলা কাটা ভূমিকা সবারই জানা। রাষ্ট্রশাসনে বঙ্গবন্ধুর অতি উদারতার সুযোগই ষড়যন্ত্রকারীরা নিতে থাকে। পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারকে করে তোলা হয় অজনপ্রিয়। বাংলাদেশে উদারতার স্থান নেই। কঠিন বাস্তবতা হলো এখানে কেউ আপনজন নেই। আবদুল আলীমের একটি গান আছে- ‘এ সংসারে কেউ নয় আপনজনা’। আসলে আপন চেনা বড় কঠিন। বঙ্গবন্ধুও চিনতে পারেননি পাশে থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের। বড় উদারতা নিয়ে সবকিছু দেখতেন। বাঙালির নেতিবাচক জায়গাটুকু শেরেবাংলা ধরতে পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই বাঁশ দেওয়ার জন্য দিয়েছিলেন আগাম টাকা।
রাজনীতির হিসাব-নিকাশটা জটিল। আমাদের রাজনীতির উদারতার দৃষ্টান্তগুলো বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ভালোবাসা দিয়ে সবটুকু জয় করতে। মানুষকে কাছে টানতে। বঙ্গবন্ধু খুব দ্রুত মানুষকে কাছে টেনে নিতেন। কাজে লাগাতেন রাজনীতিতে। এভাবে সবাই পারে না। সবাই করেও না। বঙ্গবন্ধুর আরেকটি গুণ ছিল দুঃসময়ের মানুষদের মূল্যায়ন। তিনি খুঁজে খুঁজে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসতেন। বাদ পড়েননি মোহাম্মদ উল্লাহর মতো নেতাও। আওয়ামী লীগের একজন নেতা থেকে দেশের স্পিকার, রাষ্ট্রপতি সব হয়েছিলেন। তবু তাঁর চাওয়া-পাওয়ার শেষ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে পড়েছি, আওয়ামী লীগের শুরুর দিকে পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ অফিসে এই মোহাম্মদ উল্লাহ একদিন সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তারপর বলেন, কাজ করতে চাই। দলের অফিসে সার্বক্ষণিক থাকার জন্যও একজনকে লাগে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক করেন। পত্রিকা অফিসে প্রেস বিজ্ঞপ্তি নিয়ে যেতেন মোহাম্মদ উল্লাহ। নিজেই টাইপ করতেন প্রেস বিজ্ঞপ্তি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সংসদে ডেপুটি স্পিকার করেন। ভাগ্যবান মানুষ মোহাম্মদ উল্লাহ। স্পিকার আবদুল হামিদের মৃত্যু তাঁর ভাগ্য খুলে দেয়। তিনি হয়ে গেলেন স্পিকার। দুই বছরের মধ্যে মোহাম্মদ উল্লাহর উত্থান হয় আরেক দফা। ১৯৭৪ সালের ২৪ জানুয়ারি মোহাম্মদ উল্লাহ প্রেসিডেন্ট হলেন বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু তাঁকে প্রেসিডেন্ট করলেন। কিন্তু এ পদের মর্যাদা মোহাম্মদ উল্লাহ বুঝতেন কি না জানি না। এক বছর পর দেশে রাষ্ট্রপতি-শাসিত পদ্ধতি শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু শপথ নিলেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। মোহাম্মদ উল্লাহ বাদ পড়লেন না। বঙ্গবন্ধু এবার তাঁকে মন্ত্রী করলেন। দুঃসময়ের অফিস পাহারাদারকে মূল্যায়ন করেছিলেন যথাযথভাবে। কিন্তু ইতিহাস ভীষণ নিষ্ঠুর! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যার পর মোহাম্মদ উল্লাহকে দেখা গেল আরেক রূপে। সাদামাটা চলতে অভ্যস্ত মোহাম্মদ উল্লাহ শপথ নিলেন খন্দকার মোশতাকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
মোহাম্মদ উল্লাহকে কাছ থেকে দেখলাম ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদে। তিনি বিএনপি থেকে এমপি হয়েছেন। সংসদে মোহাম্মদ উল্লাহ কথা বলতেন না। চুপচাপ এসে বসতেন হাউসে। আবার চলে যেতেন। আমি তখন কাজ করি আজকের কাগজ, ভোরের কাগজে। আওয়ামী লীগ ও সংসদ বিটের রিপোর্টার ছিলাম। নিয়মিত সংসদে যেতাম। একদিন সংসদে মোহাম্মদ উল্লাকে বললাম, আপনার একটি সাক্ষাৎকার নিতে চাই। কথা বলতে চাই আপনার দীর্ঘ জীবন নিয়ে। রাজনীতি নিয়ে। তিনি আমার দিকে তাকালেন। জানতে চাইলেন কোথায় কাজ করি। তারপর বললেন, আচ্ছা একদিন কথা বলব। সেই কথা আর বলা হয়নি। মোহাম্মদ উল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলান তাঁর ক্ষমতার নানা মেরুকরণ নিয়ে। তিনি সময় দেননি। আমিও সময় করতে পারিনি। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে তখন আমরা সারা দেশে যেতাম সংবাদকর্মী হিসেবে। সে কারণে সময় মেলেনি।
একজন মোহাম্মদ উল্লাহকে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কোথায় থামতে হবে বুঝতে পারেননি মোহাম্মদ উল্লাহ। ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার, রাষ্ট্রপতি সবই ছিলেন। এরপর একজন মানুষের আর কী চাওয়া থাকতে পারে? মোশতাকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। বিএনপি করেছেন। সবশেষে রাজনীতির সমাপনী টানেন সংসদ সদস্য হিসেবে। আমি একবার ভুল করে লিখেছিলাম, তিনি উপজেলা চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। পরে তাঁর পরিবারের লোকজন আপত্তি করলেন। তারা বললেন, না, তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন না। খবর নিয়ে দেখলাম পরিবারের কথাই সত্যি। এ যুগে এই সময়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে অনেক মানুষের নানামুখী উত্থান দেখে মোহাম্মদ উল্লাহকে মনে পড়ে গেল। চাওয়ার চেয়ে বেশি পেয়ে গেলে সমস্যা। বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি দিয়েছেন মোহাম্মদ উল্লাহকে। বঙ্গবন্ধুর মেয়েকে কাছ থেকে দেখেছি। তিনিও বাবার মতো হিমালয়সম হৃদয় পেয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেওয়ার সময় তিনি বাবাকে ছাড়িয়ে যান। তবে বঙ্গবন্ধুর মেয়ের ইতিবাচক দিক আছে। তিনি অনেক সময় কারও পরিমিতিবোধের অভাব দেখলে কেড়েও নেন। জানিয়ে দেন কারও ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। যিনি ক্ষমতায় বসান তিনি আবার কেড়েও নিতে পারেন।
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০২১
এনএসআর