ঢাকা: বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পূর্ণ হলো গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারি। এটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক যে, এক যুগেও এই বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত তদন্ত করেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তিনি বলেন, রহস্যজনকভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে প্রকৃত তদন্তের বিষয়টি। হত্যার পর সাগর-রুনির খুনিরা বাসা থেকে ল্যাপটপ নিয়ে যায়, অথচ সেই ল্যাপটপ ১২ বছরেও উদ্ধার হয়নি। ঠিক যেমন উন্মোচন হয়নি, সেই ল্যাপটপে কী গোপনীয় বিষয় ছিল, তার কোনো তথ্য।
সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন রুহল কবির রিজভী।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব আরও বলেন, ঢাকাতেই নিজ বাসায় সাংবাদিক দম্পতির খুনের ঘটনার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। দুই দিন পর পুলিশের আইজি বলেছিলেন, তদন্তের ইতিবাচক ও প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। অবিশ্বাস্য বাস্তবতা হলো, মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার তারিখ এখন পর্যন্ত ১০৫ বার পিছিয়েছে। দুর্নীতি-দুঃশাসন-দুর্বৃত্তায়নে আওয়ামী লীগের বহুমাত্রিক বিশ্ব রেকর্ডের মাঝে একটি হত্যা মামলায় ১০৫ বার তদন্ত প্রতিবেদন পেছানোও দৃষ্টান্তহীন আরেকটি নতুন বিশ্ব রেকর্ড!
তিনি বলেন, গত ১২ বছরে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার কারণ হয়তো এই যে, সাগর-রুনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এমন কিছু তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছিল এবং তারা এমন কিছু বিষয় জেনে ফেলেছিলেন, যা ক্ষমতাসীনদের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও হুমকিস্বরূপ। যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ছিল সাগর-রুনির সাংবাদিকতার অন্যতম বিষয়, যে খাত থেকে রাষ্ট্রীয় মদদে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, সেই খাতের লুটপাট তথা নেপথ্যের কুশীলবদের সাথে এই হত্যা ও বিচারহীনতার সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয়!
রিজভী বলেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র ২০২২ সালে জানায়, বাংলাদেশজুড়ে প্রায়ই হত্যা, গুম, খুন ও অপহরণসহ সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে এবং ১০ বছরে এই ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন ৩০ সাংবাদিক, যার বিচার আজও হয়নি। গত ১৫ বছরে সাংবাদিক হয়রানি ও নির্যাতনের যে ৪ হাজারটিরও বেশি ঘটনা ঘটেছে, এর প্রায় প্রতিটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের টেন্ডারবাজ, তদবিরবাজ ও দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীরা জড়িত বলে প্রতীয়মান।
শুধু তাই নয়, গণমাধ্যমের তথ্যমতে এই সরকারের আমলে ৫৯ জন সাংবাদিক হত্যা হয়েছে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২৫০ এর অধিক সাংবাদিক চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর বিএনপির শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশকে পুলিশ পণ্ড করতে তাদের ছোড়া টিয়ারশেলের আঘাতে সাংবাদিক রফিক ভুঁইয়া নিহত হন। অথচ নিহত রফিক ভুঁইয়ার মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ঘোষণা করতে বাধ্য করেছে সরকার।
রিজভী আরও বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। অথচ গণমাধ্যমের ওপর বিভিন্ন বাধা নিষেধ আরোপ করে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করা হয়েছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের অপরাধে পরিকল্পিতভাবে খুন করছে গণবিরোধী সরকার। এসব খুনের ঘটনায় ন্যায়বিচার থেকে বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিটি ভুক্তভোগী পরিবার। আসামিদের দাপটে তারা অসহায়, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে, এই সন্ত্রাসী আসামিরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
তিনি বলেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ জানায়, ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম-অন্যায়-অপকীর্তি, দুর্নীতি-দুরাচার নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করার জেরে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর অব্যাহত হামলা-মামলা-নির্যাতন ও হত্যা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত করা হয়েছে। সাংবাদিক নির্যাতন করলে, এমনকি হত্যা করলেও যে কোনো শাস্তি হয় না, ফ্যাসিস্ট সরকার এটি প্রতিষ্ঠিত করেছে। গণমাধ্যমের কণ্ঠস্বর রোধে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে প্রয়োগ করছে ডিজিটাল কিংবা সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইন।
রিজভী বলেন, যেকোনো সমালোচনাকে আওয়ামী সরকার বিপন্নবোধ করে বলেই সাংবাদিকদের ওপর হামলার পাশাপাশি গণমাধ্যমের স্বাধীন অস্তিত্ব বিপন্ন করার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। তাই তারা একের পর এক বন্ধ করেছে চ্যানেল ওয়ান, ইসলামিক টিভি, দিগন্ত টিভি, আমার দেশ, দৈনিক দিনকালসহ অসংখ্য অনলাইন পোর্টাল। ফলে হাজার হাজার সাংবাদিক বেকার হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। বাংলাদেশে আজ এমন এক পরিস্থিতি যেকোনো সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের মালিকপক্ষে বিরোধী দলের ঘনিষ্ঠজন আছেন জানলে, জোরপূর্বক ও অবৈধভাবে সেগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে জনবিদ্বেষী সরকার।
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক যুগ আজ পেরিয়ে গেল। অথচ আজও তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলো না, খুনিদের শনাক্ত করা হলো না, বিচারের ন্যূনতম উদ্যোগ নেওয়া হলো না। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা এই স্বেচ্ছাচারী রহস্য উন্মোচনের দাবি জানাই, সাগর-রুনি হত্যার বিচার চাই। আমরা চাই, প্রতিটি সাংবাদিকের নিরাপত্তা, তাদের পেশাগত স্বাধীনতা। চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অনিবার্য বিজয়ের মাধ্যমে স্থাপিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে সাগর-রুনি হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে আমরা সকল সাংবাদিকের নিরাপত্তা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করব।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪
টিএ/এমজেএফ