ঢাকা: আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করেছে তা জনবিরোধী বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ (মার্কসবাদী)। ঘোষিত বাজেট প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে এ বাম রাজনৈতিক দলটি।
শুক্রবার (৭ জুন) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে নেতারা বলেন, বৃহস্পতিবার (৬ জুন) সরকার প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করেছে যার সিংহভাগ আসবে জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর থেকে। বাকি টাকা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ থেকে। অর্থাৎ জনগণ শুধু টাকা জোগাবে, ভোগ করবে ধনীরা। আওয়ামী লীগ সরকার একতরফা ও অবৈধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসে ২০২৪—২৫ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করেছে তা জনবিরোধী।
সভাপতির বক্তব্যে বাসদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানা বলেন, বাজেট বক্তৃতায় লোক ঠকানোর জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলা হয়। কিন্তু কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয় না। জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা। খাদ্যে মূল্যবৃদ্ধি প্রায় ১১ শতাংশ। ২০২২ সালের হিসেবে, উন্নয়নশীল ১৭টি দেশের মধ্যে খাবারের জন্যে সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু খরচ করেন বাংলাদেশের নাগরিকেরা, যার পরিমাণ ৯২৪ ডলার। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৬.৫ শতাংশ আনার কথা বলা হয়েছে বাজেটে। অথচ এ বছরের মার্চ থেকে বিদ্যুতের দাম খুচরায় ৮.৫ শতাংশ এবং পাইকারিতে ৫ শতাংশ দর বাড়িয়েছে সরকার। প্রতি চারমাস পরপর তারা এটা বাড়াবে। প্রিপেইড মিটারে অস্বাভাবিক হারে বিল কাটা হচ্ছে, মানুষের অবস্থা দিশেহারা। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সবকিছুর দাম বাড়িয়ে, আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে এ মূল্যস্ফীতি কমনোর কথা বলা মানে একটা ফাঁকা বুলি ছুড়ে দেওয়া, দাম কমানো নয়।
মাসুদ রানা বলেন, বাজেট ঘাটতি মোট বাজেটের ৩২ শতাংশের ওপরে। বাস্তবে প্রতি অর্থবছর শেষে প্রকৃত ঘাটতি বাজেট দাঁড়ায় ৪৫ শতাংশের ওপরে। এ ঘাটতি বাজেট দেশি বিদেশি ঋণ নিয়ে পূরণ করা হয়, এবারো তাই হবে। এমনিতেই সরকার ঋণের ভারে জর্জরিত। ঋণের সুদ পরিশোধের জন্যই বাজেটে বরাদ্দ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট বাজেটের সাত ভাগের এক ভাগ। ঋণনির্ভর এ বাজেটে কী করে চলমান অর্থনৈতিক সংকট, বৈদেশিক লেনদেনের বিপুল ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয়, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি কাঠামোগত সমস্যা মোকাবিলা করা হবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই।
মাসুদ রানা বলেন, আজিজ, বেনজীর, আনার—কাণ্ডে সরকারের দুর্নীতির যে ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে, তা নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় চলছে। অথচ বাজেট প্রস্তাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখে দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করার ব্যবস্থা হচ্ছে। বৈধ আয়ে সর্বোচ্চ কর যেখানে ৩০ শতাংশ, সেখানে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মাসুদ রানা বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ নেই, বরাদ্দ বেড়েছে জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা খাতে। ১৭ কোটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে বাজেটের ৫.১৯ শতাংশ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হতে হবে জিডিপির ৫ শতাংশ ও মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে একজন রোগীকে চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৪ শতাংশ মেটাতে হয় নিজের পকেটের টাকায়, বর্তমানে সরকার ব্যয় করে মাত্র ২৬ শতাংশ। যার ফলে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশের ১ কোটি ১৪ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির এ সময়ে স্বাস্থ্যখাতে জনগণের দায় না নিয়ে বরং আরও বৃদ্ধি করা হলো।
মাসুদ রানা বলেন, শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের প্রায় ১১.৮৮ শতাংশ অর্থাৎ মোট জিডিপির ২ শতাংশেরও কম শিক্ষা খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের ২৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি প্রায় সব মহল থেকে করা হয়েছে। ইউনেস্কোর পরামর্শ অনুযায়ী, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত।
এ বাজেটে ধনীরা পাবে করছাড় আর গরিবরা জোগাবে দেশ চালানোর খরচ এমন মন্তব্য করে মাসুদ রানা বলেন, এবারের বাজেটে পরোক্ষ কর ৬৩.৪ শতাংশ এবং তা জোগাবে সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক ও ভ্যাট ইত্যাদি পরোক্ষ করের মাধ্যমে। আগে শিল্পের কাঁচামালে শুল্ক ছিল না, এখন ১ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়বে। মোবাইল ফোনের কল রেট, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতি ও টিউবলাইট, মেট্রোরেলের ভাড়া, দেশি ফ্রিজ, পানির ফিল্টার, বিনোদনকেন্দ্র, ফলের রস, আইসক্রিম ইত্যাদিতে ভ্যাট বাড়ানোর ফল ভোগ করবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ। অন্যদিকে বাজেটে শতকোটি টাকার মালিকদের করপোরেট করহার ২৭.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে।
অবিলম্বে এ বাজেট প্রত্যাহারের দাবি জানান দলটির এ কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনকে জোরদার করতে সব বাম গণতন্ত্রমনা জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বাসদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় সদস্য এবং ঢাকা নগরের সমন্বয়ক কমরেড জয়দীপ ভট্টাচার্য ও সীমা দত্ত।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৪ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০২৪
ইএসএস/জেএইচ