ময়মনসিংহ : প্রায় দুই যুগ বিএনপি’র রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন বাবুল মাস্টার। দল:অন্ত প্রাণ এ নেতা ছিলেন ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ২ নং রামভদ্রপুর ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি।
নিজ ইউনিয়নে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে জীবনের অনেক সময় ব্যয় করেছেন। কিন্তু ২২ মার্চের আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্যের জের ধরে কঠিন শোকাতাপ নিয়ে তাকে দলের রাজনীতি ছাড়তে হয়েছে।
স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপি’র মনোনীত প্রার্থীর বদলে ‘সুযোগ সন্ধানী’ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ায় তার নেতৃত্বে গত বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দল ছেড়ে আ’লীগে যোগ দিয়েছেন ৫ শতাধিক নেতা-কর্মী।
মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী, পরীক্ষিত, নিবেদিতপ্রাণ ও দক্ষ সংগঠকদের দল ছাড়া নিয়ে জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করে তৃণমূলের এ রাজনীতিক বাংলানিউজকে বলেন, ইউপি নির্বাচন কতিপয় নেতার কপাল খুলে দিয়েছে। ম্যাডামের চারপাশে সবাই টাকার জন্য ব্যস্ত। দল নিয়ে তাদের চিন্তা নেই।
দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য শাহ শহীদ সারোয়ার থেকে শুরু করে প্রার্থী বাছাইয়ে দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতাদের পকেটে উঠেছে মনোনয়ন বাণিজ্যের কোটি কোটি টাকা। এ নিয়ে মিডিয়ায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে।
তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের আর্তনাদ উঠে এসেছে। কিন্তু ম্যাডামই তো তৃণমূলের আর্তনাদ শুনলেন না ! আসলে এই দলে এখন টাকা জিন্দাবাদ। ’
দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু এ ইউনিয়নেই নয়, ৫নং ফুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ, ৮নং রূপসী ইউনিয়ন ও ৬নং পয়ারি ইউনিয়নসহ ১০টি ইউনিয়নের বেশিরভাগেই নিলামে তুলে বিতর্কিত ও ভিন্নমতের লোকজনকে কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।
ফ্রি স্টাইলে মনোনয়ন বাণিজ্যের সূত্র ধরেই গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের জনপ্রিয় অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে ‘নিলামে তুলে ইউপি নির্বাচনে বিএনপি’র মনোনয়ন বিক্রি’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
রাখঢাক না করেই মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রতিবাদে সপ্তাহখানেক আগে একটি ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা ঘোষণা দিয়ে দল ছেড়েছেন। এ নিয়ে এখনো তোলপাড় চলছে স্থানীয় রাজনীতিতে।
আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাত্র মাসখানেক আগে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে নেতা-কর্মীদের ক্ষমতাসীন দলের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার ঘটনার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আরো বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে দলীয় রাজনীতিতে।
আপাতত ওইসব ইউনিয়নে নেতা-কর্মীরা দলে থাকলেও টাকা দিয়ে মনোনয়ন বাগিয়ে আনা নেতাদের ভোটের মাঠে ধরাশায়ী করে কঠিন জবাব দিতে চায় তারা, এমনটি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ভাষ্যে, স্থানীয় দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য থেকে শুরু বিএনপি’র হাইকমান্ড পর্যন্ত এখন ধান্ধা একটাই, টাকা।
মনোনয়ন স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়েছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি সিন্ডিকেট। সাবেক এমপি সারোয়ারের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক দরদামে তারা মনোনয়ন বিক্রি করেছেন।
টাকার অভাবে মনোনয়ন না পেয়ে হতাশার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মোশাররফ সোহাগ।
উত্তর জেলা বিএনপি’র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহবায়ক মোতাহার হোসেন তালুকদারের শেষ মুহূর্তের হস্তেক্ষেপে শেষ পর্যন্ত তিনি ও তার অনুসারীরা দল ছাড়েননি।
তবে দ্রোহের অনলে পোড়া এ নেতা বাংলানিউজকে বলেন, টাকার জন্য মনোনয়ন পাইনি। শুনেছিলাম মনোনয়ন বাণিজ্যে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে ম্যাডাম কঠিন ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই নির্দেশও ধামাচাপা পড়ে গেছে।
দলটির তৃণমূলের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, বিএনপিতে এখন ত্যাগ, যোগ্যতা বা জনপ্রিয়তা বিবেচ্য বিষয় নয়। এখানে আসল হচ্ছে টাকা। টাকা জিন্দাবাদ নীতির কারণেই দল সাংগঠনিকভাবে নি:শেষ হচ্ছে। আর কঠিন খেসারত দিতে হচ্ছে ম্যাডামকে।
উপজেলার ৫ নং ফুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন তিনবারের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান খোকা।
স্বদলীয় মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রকাশ্য সমালোচক এ নেতা বাংলানিউজকে বলেন, কোরবানির উটের দামের চেয়েও বেশি দামে নিলামে তুলে মনোনয়ন বিক্রি হয়েছে।
তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
একই রকম মন্তব্য স্থানীয় ৬ নং পয়ারি ইউনিয়নে বিএনপি’র মনোনয়ন বঞ্চিত বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনেরও।
সূত্র মতে, সপ্তাহখানেক আগে দলীয় পরিমণ্ডলে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল, মনোনয়ন নিলাম বাণিজ্যে জড়িত স্থানীয় দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য শাহ শহীদ সারোয়ার ও কেন্দ্রের তিন নেতার বিরুদ্ধে কারণ দর্শাও (শোকজ) নোটিশ দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।
এতে আশান্বিত হয়েছিলেন দলীয় নেতা-কর্মী ও মনোনয়ন বঞ্চিতরা। কিন্তু দিন দুয়েক আগে সেই নির্দেশও ওই সিন্ডিকেটের কুটকৌশলে মাটিচাপা পড়েছে। ফলে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা নতুন করে ক্ষোভের অনলে পুড়তে শুরু করেছে।
অবশ্য ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপি’র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহবায়ক ও তারাকান্দা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন তালুকদার বাংলানিউজের কাছে দাবি করেন, ম্যাডাম তৃণমূলের আর্তনাদ শুনেছেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৬
জেডএম/