ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বিদ্যুৎ রপ্তানি করবে বাংলাদেশ!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
বিদ্যুৎ রপ্তানি করবে বাংলাদেশ! ছবি :কাশেম হারুন/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: লোডশেডিং নেই। এখন বিদ্যুৎ সারপ্লাস হচ্ছে।

সে কারণে রপ্তানি করার কথা চিন্তা করছে বাংলাদেশ। অনেকে হয়তো এই কথা বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কিন্তু এটাই না কি এখনকার বাস্তবতা।

এমন তথ্যই জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন। সোমবার বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানান তিনি।

মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘শীতকালে আমাদের চাহিদা অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। সোমবার ভোর ৪টায় সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল মাত্র ৩ হাজার ৬৮৫ মেগাওয়াট। আর আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা এখন ১২ হাজারের উপরে।

নিয়মিত মেরামত কার্যক্রমের জন্য কিছু কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ থাকার হিসেবও যদি ধরি, তাহলেও ‌উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ১০ হাজারের মতো। সে হিসেবেও মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। পুরো শীত মৌসুমে এই চিত্র থাকে। তাই বিদ্যুৎ রপ্তানির বিষয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। এর জন্য মার্কেটও রয়েছে। নেপাল আমাদের দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে চায়। নেপালের ভূ-প্রকৃতি এজন্য বিশেষ সুবিধা তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের দেশে শীতের সময় চাহিদা কমে যায়। আর নেপালে শীতের সময়ে চাহিদা বেড়ে যায়।

শীতে যখন নেপালের চাহিদা বেড়ে ‍যায় ঠিক সেই সময়ে তাদের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যায়। তাদের বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রই নদীর পানি প্রবাহের ওপর নির্ভর করায় কমে ‍যায় এগুলোর উৎপাদন। তাই শীতকালে নেপাল বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে আগ্রহী।

‘কিন্তু এখনও তো লোডশেডিং হওয়ার কথা শোনা যায়’, এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, উৎপাদনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। তাই এই জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বিদ্যুতের উৎপাদন ঘাটতির কারণে এই লোডশেডিং হচ্ছে না। অনেকগুলো প্রকল্প চলছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে এই সংকট কেটে যাবে।

পূর্বাচলে স্মার্ট গ্রিড

পাওয়ার সেল’র এই মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশ ‌এখন আর আগের অবস্থানে নেই। এখন আমাদের লক্ষ্য উন্নত ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ। সে কারণে স্মার্ট গ্রিডের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকারি আবাসন প্রকল্প পূর্বাচল ও উত্তরায় প্রথম বাস্তবায়ন করা হবে। এই দু’টি এলাকায় মাটির উপরে দৃশ্যমান কোন লাইন থাকবে না। সব যাবে মাটির নিচ দিয়ে। এখন যেগুলো খুঁটি রয়েছে সেগুলো সরিয়ে ফেলা হবে।

‘সরকার বিশাল বিশাল স্বপ্ন দেখাচ্ছে, স্বপ্ন ভঙ্গের শঙ্কা নেই তো? এর আগে ২০১০ সালে তৎকালীন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এসএম আলমগীর কবীর বলেছিলেন, এখন বিদ্যুতের দাম বাড়লেও ২০১৪ সালে গিয়ে দাম কমবে। কিন্তু ঘটেছে উল্টো, দফায় দফায় বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। ’

জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘তৎকালীন চেয়ারম্যান ফ্লাইং কিক দিয়ে গেছেন। তার কথার বাস্তবতা ছিল না। এখন তেমনটি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

‘গুঞ্জন উঠেছে আবার না-কি দাম বাড়ানো হবে বিদ্যুতের?’ জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বিদ্যুতে উৎপাদন ও বিক্রির মধ্যে ঘাটতি রয়েছে। এখন বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। এই টাকা সমন্বয় হওয়া দরকার। আমার মনে হয় একটা প্রক্রিয়া চলছে’।

‘বিদ্যুতের দাম বাড়লে মানুষ সাশ্রয়ী হয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন ও বিক্রয় মূল্য সমান হওয়া উচিত। তবে কোন অনিয়ম কিংবা ‍চুরির দায়ে লোকসান হলে গ্রাহকের উপর চাপানো উচিত হবে না। চুরি কারণে লোকসান হয়ে থাকলে সরকারকে কঠোর মনিটরিং করতে হবে। ’

তিনি বলেন, “জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ভর্তুকি দেওয়ার কোন অর্থ হয় না। একদিকে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রফিট করছে। প্রফিট ট্রু হওয়া উচিত’।

‘অনেকে মনে করেন রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো কারণেই বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। ’ এই প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘এগুলোকে আর রেন্টাল বলা যায় না। এগুলো এখন আইপিপি হিসেবে চলছে। এগুলোতে কোন ভাড়া নেই। তেলের ব্যবহার বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ’

‘এখন যদি তেলের দাম কমতো তাহলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তো না’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

‘বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমে গেছে। বাংলাদেশেও তেলের দাম কমানো উচিত কি-না?’ এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে বলবো তেলের দাম কমানো উচিত। তেলের দাম কমলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও কম থাকতো। বিষয়টি অর্থনীতিবিদরা নিশ্চয় ভালোভাবে মূল্যায়ন করে দেখবেন। ’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেসব কোম্পানি নিজেরা তেল আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে সেখানে খরচ পড়ছে ৭ টাকা। আর বিপিসির কাছ থেকে তেল কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১৫ টাকার মতো। ’

‘বিশাল বিশাল প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। অর্থ সংকট দেখা দিতে পারে কি-না?’ জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘এখন অর্থের কোন সংকট নেই। অনেক খ্যাতনামা বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে। এর পেছনে বাংলাদেশের ধারাবাহিক এগিয়ে যাওয়া ভীষণভাবে কাজে দিয়েছে। বিদেশিরা এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগে অতীতের যে কোন সময়ে চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ’

‘অর্থের যদি কোন সংকট নাই থাকবে তাহলে বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ কেন?’ এ প্রশ্নের জবাবে পাওয়ার সেলের ডিজি বলেন, ‘বন্ড ছাড়ার মানে অর্থ সংকট নয়। গ্লোবাল মার্কেটে প্রবেশ করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন্ড ছাড়লে কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে।

প্রথম দফায় ১ বিলিয়ন ডলার বন্ড ইস্যুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানান মোহাম্মদ হোসাইন।

‘বিদ্যুৎ খাতের মাস্টার প্ল্যানে কিছু পরিবর্তনের কথা শোনা যাচ্ছে এটা কি সঠিক?’

জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে ২০৩০ সালের মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা ছিল। এখন এই লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করে ৬ হাজার মেগাওয়াট করা হয়েছে। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। নেপালের আপার কার্নালি ও আপার মাছরাঙিতে ভারতীয় কোম্পানি জিএমআর জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে। সেখান থেকে ৫‘শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত হয়েছে।

অন্যদিকে ভুটান তাদের দেশে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে ১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। সেখান থেকে বিদ্যুৎ আসবে বাংলাদেশে। এতে ভারতও যুক্ত হতে চাইছে। ত্রি-দেশীয় মালিকানায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি অনেকটাই চূড়ান্ত বলা যায়।

সৌরবিদ্যুতে নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে। সৌর বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে, একে রাতের বেলা ব্যবহার উপযোগী করতে হলে বিনিয়োগ বেড়ে যায় ৪০ শতাংশ। তাতে ঝামেলাও অনেক বেশি। চীন চাইছে একটি সোলারের সিল্ক রুট তৈরি করতে। যার অপর প্রান্ত থাকবে আফ্রিকার সঙ্গে যুক্ত। যখন যে অঞ্চলে দিন সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। সবাই ব্যবহার করবে। এতে ব্যাটারি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে না। ’

‘ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য এ পর্যন্ত তিনটি চুক্তি করা হয়েছে। প্রত্যেকবারেই দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম দফায় ইউনিট প্রতি দাম ছিল আড়াই রুপি, দ্বিতীয় চুক্তি হয় ৪ দশমিক ৪৭ রুপি। সর্বশেষ ত্রিপুরার সঙ্গে প্রতি ইউনিটের দর নির্ধারিত হয়েছে সাড়ে ৫ রুপি। এর কারণ কি?’ 

জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘প্রথম ২৫০ মেগাওয়াটের চুক্তিটিকে স্মারক বলা যেতে পারে। ভারত বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে এই বিদ্যুৎ দিয়েছে। আর শেষের চুক্তিটি হয়েছে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে। এতে বিদ্যুৎ না এলে কোন চার্জ দিতে হবে। সে অর্থে শেষ চুক্তিটিতে বাংলাদেশ লাভবান হয়েছে। ’

‘আপনারা একদিকে যখন বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটারিংয়ের কথা বলছেন, ঠিক তখন এনালগ মিটার স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। এতে করে দু’দফায় অর্থ অপচয় হবে। ’

এই প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমরা চাইলেই পুরোপুরি প্রি-পেইড মিটারে যেতে পারছি না। কারণ বিতরণ কোম্পানিগুলো এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। তবে আগামী দুই বছরের মধ্যে সারাদেশে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হবে। আমরা চাচ্ছি গ্রাহকরা যেন ঘরে বসেই রিচার্জ করতে পারে। সে জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আগে কোম্পানিগুলোতে সার্ভার বসানোর জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই কোম্পানির চিটিংয়ের কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে বলে দাবি করেন মোহাম্মদ হোসাইন।

পাওয়ার সেল পরিকল্পনা ও নীতিমালা তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমানে বিদ্যুৎ আইন এবং ইউনিফাইড সার্ভিস রুল তৈরির কাজ চলছে। এই রুল তৈরি হলে এক কোম্পানির সঙ্গে অন্য কোম্পানি বেতন বৈষম্য দূর হবে বলে জানান মোহাম্মদ হোসাইন।

২০০৪ সালে পাওয়ার সেলে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে যোগ দেন মোহাম্মদ হোসাইন। ২০০৯ সালে পদোন্নতি পেয়ে হন ডাইরেক্টর (ম্যানেজমেন্ট)। ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বভার নেন তিনি।

মোহাম্মদ হোসাইন ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে প্রকৌশল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিএ পাস করেন। কর্মজীবনে মাধ্যমিক ও ‌উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ডাইরেক্টর জেনারেল, ডাটেক লিমিটেড’এ হার্ডওয়ার এন্ড সেলস ইঞ্জিনিয়ার (১৯৮৮-৮৯), ইউনিডেভ লিমিটেড’এ সিসটেম ম্যানেজার (১৯৮৯-৯০), সেনা কল্যাণ সংস্থায় এমআইএস এন্ড এইচআরএম ম্যানেজার (১৯৯০-৯৬) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সুনামের সঙ্গে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
এআই/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।