মাওলানা আতাউল হক জালালাবাদী। বিশিষ্ট আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদ।
খোশ আমদেদ মাহে রজমান
দীর্ঘ এক বছর পর আবার আমাদের দ্বারে উপস্থিত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমজান। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জরুরি এই মাসকে খোশ আমদেদ জানানো, স্বাগত জানানো। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে কারিমে ঘোষণা হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)। কোরআনের এই আয়াতে রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জিত হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের পন্থা
রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের পদ্ধতি ও ইসলামে রমজান মাসের গুরুত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হজরত সালমান ফারসি (রা.) এক দীর্ঘ হাদিসে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন। তিনি বলেন, ‘শাবান মাসের শেষ দিন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের উদ্দেশে একটি ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘বিরাট পুণ্যময় বরকতপূর্ণ একটি মাস তোমাদের নিকটবর্তী। এ মাসটি এতই পুণ্যময় যে, তাতে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। আল্লাহতায়ালা এ মাসের দিনের বেলায় তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করেছেন। আর কিয়ামুল লাইল (তারাবির নামাজ) সুন্নত হিসেবে প্রতিপালনীয় করেছেন। এ মাসে ভালো কাজের প্রতিদান এত অধিক যে, কোনো ব্যক্তি একটি নফল আদায় করলে অন্য মাসের একটি ফরজ ইবাদতের প্রতিদান পাবে। আর এ মাসে একটি ফরজ আদায় করলে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের প্রতিদান পাবে। এই মাসটি ধৈর্য ও সবরের মাস। আর ধৈর্য-সবরের প্রতিদান হলো জান্নাত। এটি সহমর্মিতার মাস। এটি এমন এক পুণ্যময় মাস যে মাসে মুমিনের রিজিকে প্রবৃদ্ধি ঘটানো হয়ে থাকে। এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করালে তার গোনাহ মাফ হয়ে যায়, জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত পাওয়া যায় এবং রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াবের অংশীদার হয়; কিন্তু রোজাদারের সওয়াবের কোনো হ্রাস হয় না। ’
আমরা প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের অনেকেই রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য রাখে না। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, ‘আল্লাহতায়ালা এই পরিমাণ সওয়াব ওই ব্যক্তিকে প্রদান করবেন যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে সামান্য দুধ দিয়ে কিংবা খেজুর দিয়ে কিংবা পানির শরবত দিয়ে ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি রমজান মাসে কোনো রোজাদারকে পেট পুরে আহার করাবে আল্লাহতায়ালা (কিয়ামতের দিন) তাকে আমার হাউজে কাউছারের পানি পান করিয়ে পরিতৃপ্ত করবেন। এ পানি পান করার পর জান্নাতে প্রবেশ করার আগে সে আর তৃষ্ণার্ত হবে না। এ মাসের প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের এবং শেষ দশক জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাতের। এ মাসে যে ব্যক্তি নিজের অধীনস্থদের কাজকর্ম হালকা করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত দেবেন। ’ -মিশকাত শরীফ
রমজান ও রোজার শিক্ষা
বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজান এবং রোজার যে বিশাল গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন তা আমাদের ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে। হাদিসের মর্মবাণী আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। পুরো রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ দুটো ইবাদত হচ্ছে- দিনের বেলায় রোজা রাখা, আর রাতের বেলায় তারাবির নামাজ আদায় করা
তারাবির নামাজ নিয়ে জটিলতা কাম্য নয়
তারাবির নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে সমাজের ভেতর একটি সুবিধাবাদী গ্রুপের সন্ধান পাওয়া যায়। কেউ কেউ ৮ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করে দাবি করে থাকেন যে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে ৮ রাকাত তারাবির নামাজ আদায়ের বর্ণনা পাওয়া যায়। তাদের উদ্দেশে আমার প্রশ্ন হলো, ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায়ের বর্ণনাও তো হাদিস শরিফেই বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং বিশ রাকাত আদায় করতে আপনাদের অসুবিধাটা কোথায়?
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কমবেশি তারাবির নামাজ আদায়ের ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি এই ইবাদত নিয়মিতভাবে করলে উম্মতের ওপর তা ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ থেকেই তো বোঝা যায়, তারাবি মুসলমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। খোলাফায়ে রাশেদিন ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের আমল ২০ রাকাতের ওপর। হজরত ওমর ফারুক (রা.) তার শাসনামলে ২০ রাকাত তারাবি আদায়ের জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ জারি করে তা বাস্তবায়ন করেছেন। আর হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমার এবং আমার খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নত দৃঢ়ভাবে ধারণ করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য। অতএব, বোঝা গেল, কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কিয়াস ২০ রাকাত তারাবির পক্ষে। সুতরাং গুরুত্বের সঙ্গে এই আমল সব মুসলমানের প্রতিপালন করা জরুরি একটি বিষয়।
রমজানে ওমরা করা সওয়াবের কাজ
রমজান মাসে ওমরা করার জন্যও হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ মাসে ওমরা পালন করলে হজের সওয়াব পাওয়া যাবে। ’ আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের দেশের এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমান এ মাসে ওমরা পালন করার জন্য বায়তুল্লাহর উদ্দেশে ছুটে যান। আমাদের দেশের সম্পদশালীরা হজ আদায় না করে রমজানে ওমরা পালন করেই মনে করেন, তার হজের ফরজ আদায় হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত, হজ আদায় না করে শুধু ওমরা আদায় করা জায়েয নয়। তার এই ওমরাও আদায় হবে না; বরং গোনাহ হবে। তাই সবার উচিত প্রথমে হজের ফরজ আদায় করা অতঃপর যত খুশি ওমরা পালন করতে থাকা।
যেভাবে রমজান কাটাতে হবে
রমজান মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আজকার, তেলাওয়াতে কোরআনের আমল জারি রাখতে হবে। সেই সঙ্গে গিবত, শেকায়েত, পরনিন্দা, পরচর্চা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে চলতে হবে। কেননা, এগুলো সম্পূর্ণ রোজার উদ্দেশ্য পরিপন্থী কাজ। এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়, বরং প্রকৃত রোজা হলো বেহুদা-অযাচিত কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা। ’
আমাদের দেশে রাজনৈতিক ময়দানে একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য এজাতীয় কথাবার্তার ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। মুসলমানের জন্য এটা খুবই দুঃখজনক। এসব কাজ থেকে অন্ততপক্ষে রমজান মাসে বিরত থাকবেন বলে দেশের মুসলমানরা তাদের কাছে আশা করেন। রমজান মাসের অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে শেষ দশকে ইতিকাফ করার বিরাট ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। এ সময় বেজোড় রাতগুলোতে শবেকদর অনুসন্ধান করে ইবাদত করা উচিত। জাকাত, সদকায়ে ফিতর ইত্যাদি ইবাদত এ মাসে করে নিলে অধিক সওয়াব পাওয়ার সুসংবাদ এসেছে।
গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশা
রমজান মাস খুবই পবিত্র ও বরকতময়। এই মাসের পবিত্রতা রক্ষায় গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা জানি, ইসলামের প্রতি দেশের প্রত্যেক মুসলমানের অগাধ ভালোবাসা ও নিখাঁদ ভক্তি রয়েছে। গণমাধ্যমের কর্ণধাররা এর ব্যতিক্রম নন। তারা জাতির বিবেক ও মাথাতুল্য। তাই তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা একটু বেশিই। আমি আশা করবো, রমজান মাসে অশ্লীল বিজ্ঞাপন ও ইসলাম পরিপন্থী বিষয়াদী প্রচার থেকে তারা বিরত থাকবে। এছাড়া গণমাধ্যম রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, যানজট নিরসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। রমজানের গুরুত্ব ও ফজিলত বিষয়ক লেখা বা অনুষ্ঠানের পরিমাণ আরও বাড়ানো যেতে পারে। এর ফলে মানুষের ইবাদতের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। এক কথায় বলা যায়, রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বিষয়টি গণমাধ্যমে কর্তাব্যক্তিদের মাথায় থাকলে দেশ ও জাতির মঙ্গল।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৯ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৫
এমএ/