কাদেরকে জাকাত দেয়া যাবে, এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয়ই ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী, (ইসলামের প্রতি অমুসলিমদের) হৃদয় আকৃষ্ট করার জন্য, দাস মুক্তি, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে জেহাদেরত এবং মুসাফিররা জাকাতের হকদার, এ বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, আল্লাহ জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। ’ -সূরা আত তওবা: ২০
উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহতায়ালা জাকাত ব্যয়ের খাত ও তার হকদারদের বিষয়টি আটটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন।
১. ফকির ও মিসকিন
মাসয়ালা : ফকির-মিসকিন বলা হবে ওই সব লোককে, যাদের পরিবারের ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য তাদের নগদ অর্থ, বেতন-ভাতা, প্রতিষ্ঠিত শিল্প ও আয়-রোজগার যথেষ্ট নয়। অন্যের সাহায্য সহায়তার প্রয়োজন হয়। উলামায়ে কেরামের মতে, তাদেরকে এ পরিমাণ জাকাতের অংশ দেয়া উচিত, যাতে সামনের বছর জাকাতের সময় আসা পর্যন্ত আর অর্থের প্রয়োজন না হয়।
২. জাকাত আদায়ের কাজে নিয়োজিত কর্মচারী
মাসয়ালা : এ প্রকারের লোকেরা হলেন রাষ্ট্র কিংবা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাকাত আদায়, সংরক্ষণ ও যথাস্থানে ব্যয় করার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। তাদের নিজ নিজ কর্ম ও শ্রম অনুপাতে জাকাতের অর্থ প্রদান করা হবে, যদিও তারা ধনী হয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ কোনো লোককে তার জাকাত বণ্টনের কাজে ওকিল বা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করে, তাহলে সে জাকাতের কর্মচারী বলে বিবেচিত হবে না। সুতরাং তাকে ওকালতির কাজে জাকাতের কোনো অংশ দেওয়া যাবে না।
৩. যাদের হৃদয় আকর্ষণ করা প্রয়োজন
মাসয়ালা : তারা হচ্ছে এমন নতুন মুসলিম যাদের অন্তর এখনো দোদুল্যমান অথবা এমন লোক যাদের ক্ষতির আশংকা করা হয়; তাই তাদের ঈমানকে মজবুত করার জন্য অথবা তাদের ক্ষতি প্রতিহত করার জন্য তাদেরকে জাকাত থেকে প্রদান করা যাবে; যদি তাদের ক্ষতি প্রতিহত করার অন্য উপায় না থাকে।
৪. দাস মুক্তির জন্য
যে সকল দাস-দাসী আপন মুনিবের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে নিজেদের মুক্তির ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, তাদের জাকাত থেকে এ পরিমাণ অর্থ দেয়া যাবে, যাতে তারা এর মাধ্যমে মুক্তিলাভ করতে পারে। অনুরূপভাবে জাকাতের অর্থ দিয়ে সাধারণ দাস-দাসী ক্রয় করেও মুক্ত করা যাবে। তাছাড়া মুসলিম কয়েদি কিংবা অভিবাসীদেরকেও মুক্ত করা যাবে। কারণ এটাও দাসমুক্তির ব্যাপক নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত।
৫. যারা ঋণের বোঝা বহন করছে
যারা ঋণের বোঝা বহন করে তারা দু’প্রকার-
১. যে ব্যক্তি সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ এবং সমাজ থেকে বিশৃঙ্খলার আগুন নেভাতে গিয়ে ঋণের শিকার হয়েছে, জাকাতের অর্থ থেকে তাকে ঋণ পরিমাণ অর্থ প্রদান করা যাবে। যেন সে এমন মহতী কাজে আরও উৎসাহিত হয়, যাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও হিংসা-বিবাদ দূর হয়ে মুসলিমদের মধ্যে পরস্পর সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।
২. যে ব্যক্তি নিজের বা পরিবারের প্রয়োজন পূরণে ঋণগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু তার ঋণ পরিশোধ করার কোনো ব্যবস্থা নেই, তাকে ঋণ শোধ পরিমাণ অর্থ জাকাত থেকে প্রদান করা যাবে; যদিও তার পরিমাণ বেশি হয়। অথবা তলবকৃত ব্যক্তি (ঋণী)র কাছে না দিয়ে সরাসরি তলবকারীকে অর্থ দিয়ে দেয়া যাবে। কারণ তলবকারীর কাছে অর্থ হস্তান্তরের মাধ্যমেই তলবকৃত ব্যক্তি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করবে।
মাসয়ালা : যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্ত যে, ঋণ পরিশোধ করার পর তার কাছে জাকাতযোগ্য বা ফিতরাযোগ্য কোনো সম্পদ নিসাব পরিমাণ থাকে না, তাকে জাকাত দেয়া যাবে। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/১৮৮
৬. আল্লাহর রাস্তায়
‘আল্লাহর রাস্তায়’ বলতে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ বুঝায়; যে জেহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করা। নিজের বীরত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব অথবা দলীয় কিংবা গোত্রীয় গোড়ামী প্রদর্শনের জন্য নয়। সুতরাং এ নিয়্যতে যে জেহাদ করবে সে মুজাহিদকে জাকাত থেকে এমন অর্থ প্রদান করা যাবে যা জেহাদের পথে তার প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হবে। অথবা ইসলামের সাহায্য ও তার শত্রুদের বিতাড়ন এবং আল্লাহর বাণীকে বিজয়ী করার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জেহাদকারী মুজাহিদদের জন্য জাকাতের অর্থ থেকে যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধ সামগ্রী কেনা যাবে।
৭. মুসাফির
যে মুসাফিরের আসবাবপত্র শেষ হয়ে গেছে, জাকাত থেকে তাকে এ পরিমাণ অর্থ দেয়া যাবে যাতে সে সফর পূর্ণ করে নিজ আবাসে পৌঁছাতে পারে। এ জাতীয় মুসাফির যদি তার নিজ দেশে ধনী লোকও হয় এবং এমন কাউকে পাওয়া যায় যে তাকে ঋণও প্রদান করবে, তারপরও তাকে জাকাত থেকে প্রদান করা যাবে। তবে এভাবে জাকাতের টাকা নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে অল্প-পরিমাণ টাকা-পয়সা নিয়ে সফরে বের হওয়া মুসাফিরের জন্য উচিত নয়। -বাদায়েউস সানায়ে: ২/১৫৫
মাসয়ালা : মাদরাসার গোরাবা ফান্ডে জাকাত দেয়া যায়। এতে দ্বিগুণ সাওয়াব পাওয়া যায়। কেননা এ ফান্ডে যাতকাত দিলে একদিকে জাকাত আদায় হয় অপরদিকে দ্বীনের সহযোগিতা হয়। -সূরা তওবা: ৬০
উল্লেখ্য, মসজিদে বা মাদরাসার সাধারণ ফান্ডে কিংবা নির্মাণ ফান্ডে জাকাত দেয়া যাবে না। অনুরূপ কোনো ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজেও জাকাত দেয়া যাবে না। -ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি: ১/১৮৮
মাসয়ালা : জাকাত শুধু মুসলমানদের দেয়া যাবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমকে জাকাত দিলে জাকাত আদায় হবে না। (তবে তাদের অন্যভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা যাবে) -মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক, হাদিস: ৭১৬৬, রদ্দুল মুহতার: ২/৩৫১
মাসয়ালা : জাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত হলো কোনো ধরনের বিনিময় ছাড়া নিঃস্বার্থভাবে উপযুক্ত ব্যক্তিকে জাকাতের পূর্ণ মালিক বানিয়ে দেয়া। -রদ্দুল মুহতার: ২/৩৪৪
মাসয়ালা : বাড়ির কাজের ছেলে বা কাজের মেয়েকে জাকাত দেয়া জায়েজ। যদি তারা জাকাত নেয়ার উপযুক্ত হয়। তবে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে জাকাতের অর্থ দিলে জাকাত আদায় হবে না। তাই তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে দেয়ার পর জাকাতের অর্থ দেয়া যাবে।
মাসয়ালা : আল্লাহতায়ালার হুকুম পালন ও তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই জাকাত দিতে হবে। জনসমর্থন অর্জন, লোকদের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশ্যে জাকাত দেয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। -সূরা অাল বাকারা: ২৬৪
মাসয়ালা : যাকে জাকাত প্রদান করা হবে সে যদি জাকাতের হকদার হয় কিন্তু সাধারণত সে জাকাত গ্রহণ করে না, তাহলে জাকাত দেয়ার সময় তাকে বলে দিতে হবে যে, এটা জাকাত। যাতে করে বিষয়টি তার নিকট সুস্পষ্ট হয় ফলে সে ইচ্ছা হলে জাকাত গ্রহণ করবে ইচ্ছা হলে প্রত্যাখ্যান করবে। আর যে লোক জাকাত গ্রহণে অভ্যস্থ তাকে জাকাত দেয়ার সময় কোনো কিছু না বলাই উচিত। কেননা এতে তার প্রতি দয়া প্রদর্শনের খোঁটা দেয়া হয়। আল্লাহ বলেন- ‘হে ঈমানদারগণ খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের সদকা বা দান সমূহকে বিনষ্ট করে দিও না। ’ -সূরা বাকারা: ২৬৪
মাসয়ালা : জাকাতের জন্য যে কেউ হাত বাড়ালেই তাকে জাকাত দেয়া উচিত নয়। কেননা সম্পদশালী হওয়া স্বত্বেও অনেক মানুষ পয়সার লোভে হাত বাড়ায়। এ সমস্ত লোক কিয়ামত দিবসে এমন অবস্থায় আসবে যে তার মুখমণ্ডলে এক টুকরা গোশতও থাকবে না (নাউজুবিল্লাহ) সমস্থ মানুষের সাক্ষাতে কিয়ামত দিবসে তার মুখ মণ্ডলের শুধুমাত্র হাড়-হাড্ডি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না। এ বিষয়ে নবী করিম (সা.) বলেন- ‘যে ব্যক্তি সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মানুষের কাছে হাত পাতে সে যেন জাহান্নামের আগুন চাইল। অতএব বেশি চাইলে চাক বা কম চাইলে চাক। ’ -সহিহ মুসলিম: জাকাত অধ্যায়
মাসয়ালা : জাকাতের টাকা দিয়ে গরীবের ঘর মেরামত করার চেয়ে টাকাটা তার হাতে তুলে দিলেই জাকাত আদায়ের ব্যাপারে আর কোনো আশংকা থাকে না। অনুরূপ গরীবের মেয়ের বিয়েতে খরচ করার চেয়ে তাদের হাতে টাকাটা তুলে দিলেই ভালো হয়। মোট কথা, জাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত হলো- হকদার কে জাকাতের মালিক বানিয়ে দেওয়া। অনুরুপ গরীবকে ঔষধ ক্রয় করে দিলে কিংবা চিকিৎসা ফি দিলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। -ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম: ৬/২৪১
মাসয়ালা : মাদরাসায় কিতাব ক্রয় করে দিলে তা মাদরাসায় ওয়াকফ হয়ে যায়, কারো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন থাকে না বলে জাকাত আদায় হবে না। জাকাত আদায় হওয়ার জন্য কোনো ছাত্রকে কিতাবের মালিক বানিয়ে দিতে হবে। -দারুল উলুম: ৬/২৬২
মাসয়ালা : জাকাতের জন্য বড় শর্ত হলো- নিয়ত। যদি জাকাতের মাল পৃথক করার সময় নিয়ত করে তাহলেও যথেষ্ট হবে। আর যদি নিয়ত করতে ভুলে যায় তাহলে যতক্ষণ উক্ত মাল গ্রহীতার হাতে থাকবে ততক্ষণ নিয়ত করার সুযোগ থাকবে। নতুবা জাকাত আদায় হবে না। -ফাতাওয়া দারুল উলুম: ৬/৭৯
মাসয়ালা : যার মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে, সে যদি জাকাত নেওয়ার হকদার হয় তাহলে তার মামলা পরিচালনার কাজে জাকাতের টাকা ব্যয় করা যাবে। -ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া: ৩/৫২
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘন্টা, জুলাই ০৬, ২০১৫
এমএ