আলহাজ হাফেজ মাওলানা মো. বায়েজীদ হোসাইন। বিশিষ্ট আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদ।
রমজান মাগফিরাত লাভের অপূর্ব সুযোগ
আত্মশুদ্ধি লাভ করে মানুষ যেন উন্নততর মহত্ত্বর চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী হতে পারে, সংযম অভ্যাস করে আল্লাহ্পাকের বিধি-নিষেধ পালনে অভ্যস্ত হতে পারে, সবার ওপর এ জীবন-সাধনার মাধ্যমে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হতে পারে- এজন্যই রোজাসহ অন্যান্য ইবাদতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু অবহেলা অথবা অন্য কোনো কারণে এ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলো তবে জীবন সাধনার ব্যর্থতা হবে অনিবার্য।
হজরত উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, রমজান মাসে আল্লাহতায়ালাকে স্মরণকারী ব্যক্তিকে মাফ করা হয়, আর আল্লাহর দরবারে প্রার্থনাকারী ব্যক্তি বঞ্চিত হয় না। তাই আমাদের উচিৎ হলো বেশি বেশি প্রার্থনা করা। নিজের নাজাতের রাস্তা খোঁজা।
রোজা রেখে মিথ্যা বলা যাবে না
হজরত রাসূলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, রোজাদারের উচিত মিথ্যা কথা থেকে বিরত থাকা, কেউ যদি কারও সঙ্গে ঝগড়া করে এবং গালাগাল করে, তবে তার বলা উচিত, ভাই! আমি রোজাদার, তোমার গালির জবাব আমি দেব না। আমি কসম করে বলতে পারি, মানুষ এই হাদিসের ওপর আমল করলে অন্তত রমজান মাসে কোনো ধরনে বিশৃঙ্খলা দেখ দিত না।
রমজানে সব নেক কাজের সওয়াব বাড়ানো হয়
আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, সব নেক কাজের সওয়াবই দশ গুণ হারে হয়ে থাকে, কখনও কখনও তা পাঁচশ’ গুণ পর্যন্ত হয়ে থাকে আবার একটি নেক কাজের বদলে সাতশ’ গুণ সওয়াবও লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু রোজা সব নেক কাজ থেকে স্বতন্ত্র। এই নেক কাজের সম্পর্ক বিশেষভাবে আমারই সঙ্গে, তার বদলা আমিই দান করব, বান্দা তার পানাহারের আগ্রহ আমার জন্যই দমন করে থাকে, সুতরাং আমি নিজ হাতে তার মূল্য বা পুরস্কার দান করব। -হাদিসে কুদসি ও মুসলিম শরিফ
প্রকৃত মানুষ গঠনে রমজান
পবিত্র কোরআনে কারিম ও হাদিসের রমজান সংশ্লিষ্ট আয়াত এবং বাণী বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, প্রধান তিনটি বিষয়ের জন্য রমজান মাস বছরের অন্যান্য মাস থেকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও তাত্পর্যপূর্ণ। প্রথমত এই রমজান মাসে কোরআনে কারিম অবতীর্ণ হয়েছে, দ্বিতীয়ত, এই মাসে লায়লাতুল কদর বা মহিমান্বিত রাত নিহিত রয়েছে এবং তৃতীয়ত, সিয়ামের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এই মাসে ফরজ করা হয়েছে। এই তিনটি বিষয় পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং সেগুলোর তাত্পর্য ও বৈশিষ্ট্য আল্লাহর সৃষ্টির উদ্দেশ্যের দিকনির্দেশক। সুতরাং এই মাসকে আমাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
লায়লাতুল কদর
রমজান মাসে লায়লাতুল কদর বা মহিমান্বিত রাতের অনুসন্ধান করার কথা বলা হয়েছে। এই পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী ও পরীক্ষার স্থান। এই পার্থিব জীবনে যেভাবে কাজ করবে সেভাবে পরকালীন জীবনে তার ফল ভোগ করবে। ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত হবে এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। এই জীবনের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। আল্লাহ মানুষ ও জিনকে কেবল তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। মহানবী (সা.)-এর উম্মতের আয়ুষ্কাল পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতের তুলনায় অনেক কম। তাহলে কীভাবে এই স্বল্পমেয়াদি জীবনে মহানবী (সা.)-এর উম্মত অধিক পুণ্য সঞ্চয় করে পূর্ববর্তী উম্মতের সমপর্যায়ে আনতে পারবে। আল্লাহতায়ালা তার ব্যবস্থা করেছেন রমজান মাসে সেই মহিমান্বিত রাত নিহিত রেখে। এই রাতটি হাজার মাসের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। বছরের গণনায় এই রাত ৮৩ বছর ৪ মাসের ইবাদতের চেয়ে বেশি মর্যাদা সম্পন্ন। তাহলে কোনো ব্যক্তি যদি ন্যূনতম একটি থেকে দশটি রাত পেয়ে যায় তাহলে পূর্ববর্তী অধিক বয়সপ্রাপ্ত ব্যক্তির ইবাদতের সমপর্যায়ে ওঠা কঠিন হবে না। মহানবী (সা.) রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে এই কদরের রাত তালাশ করতে বলেছেন। তবে রমজান মাসের ২৬ দিবাগত রাতে কদর হওয়ার বেশি সম্ভাবনার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন আলেমরা। এই কদরের রাতে মহানবী (সা.)-এর উম্মতের সওয়াব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে যাত্রা যুক্ত হয়েছে তা পূর্ববর্তী কোনো উম্মতের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রমজান মাস বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
রমজানে আল্লাহতায়ালা তার বান্দার আকুঁতি বেশি করে শোনেন
আল্লাহর রহমতের ভাণ্ডার বান্দার জন্য সদাসর্বদা অবারিত। মানব জাতির মাঝে ইবাদতের অনুভূতি এবং চাওয়ার যোগ্যতা থাকলে মহামহিম আল্লাহতায়ালা বান্দার যে কোনো দোয়া শোনেন এবং তার উদ্দেশ্য ও চাহিদা পরিপূরণ করেন। যেমন আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেছেন, (‘হে নবী!) আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (আপনি তাদের বলে দিন) আমি এত নিকটবর্তী যে, কেউ যখন আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি (অর্থাৎ তার দোয়া কবুল করি)। সুতরাং তারাও আমার কথা অন্তর দিয়ে গ্রহণ করুক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে এসে যায়। ’ -সূরা আল বাকারা: ১৮৬
মনে রাখবেন, দিবানিশির এই পথপরিক্রমায় এমন কিছু সময় রয়েছে, যে সময় আল্লাহর রহমতের সাগর উত্তাল তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ে। রহমতের এই যৌবনকালে নিতান্ত একাগ্রতার সঙ্গে আল্লাহর দরবারে যা কিছু চাওয়া হয়, তার অপার দয়া ও অনুগ্রহে বান্দার সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়ে থাকে। হাদিস শরিফে এসেছে, বিশেষ কিছু মুহূর্তে আল্লাহর রহমতের বায়ু বিশেষভাবে প্রবাহিত হয়ে থাকে। রহমতের বারিবর্ষণের সময় ছোট-বড় যে-ই আল্লাহর কাছে হাত পেতে থাকে, আল্লাহ তাকে খালি হাতে ফেরান না। তার উদ্দেশ্য ভরপুর ও সফল করে দেন। অতএব আমাদের বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখা দরকার।
দোয়া প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে
যেহেতু রমজানুল মোবারকের পবিত্র মাসটি খোদায়ি রহমতের বায়ু প্রবাহের বসন্তকাল। এই মাসে রহমতের বারি বর্ষিত হয় তীব্র বেগে। বান্দাকে মাফ করে দেয়ার জন্য বাহানা তালাশ করা হয়ে থাকে। প্রতি মুহূর্তে বান্দার দোয়া কবুলের ঘোষণা চলতে থাকে। সুতরাং রমজান হলো দোয়া কবুলের মাস। এই সুবর্ণ সুযোগের কার্যকর সফলতা পেতে চাইলে এই মাসে বেশি বেশি দোয়ায় মশগুল হতে হবে। এসময় আল্লাহর কাছে নিজের হাজত-প্রয়োজন চেয়ে নিতে হবে। তবে দোয়া করার ক্ষেত্রে একটি বিষয়টি মনে রাখতে হবে, দোয়া কবুলে তাড়াহুড়ো করা যাবে না।
অর্থাৎ দোয়া কবুল হওয়ার সার্বিক অর্থ ও উদ্দেশ্যও সবাইকে মেনে নিতে হবে। অনেক সময় অজ্ঞতার দরুন মানুষ আল্লাহর দরবারে এমন জিনিসও চেয়ে বসে, যা তার জন্য কল্যাণকর নয়। এহেন অবস্থায় আল্লাহ তাকে তার প্রত্যাশিত জিনিসটি না দিয়ে এমন জিনিস দিয়ে থাকেন, যা তার জন্য শেষ পরিণতিতে কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক হয়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন মুসলমান দোয়া করে, যতক্ষণ তা সম্পর্কছিন্ন কিংবা কোনো গোনাহের কাজে জড়ানোর দোয়া না করে, ততক্ষণ আল্লাহর পক্ষ থেকে তিন বিষয়ের কোনো একটি অবশ্যই তার প্রাপ্ত হয়ে থাকে। ১. সে যা চায় তাই সে পেয়ে যায়, ২. কিংবা তার পরিবর্তে তার ওপর আগত কোনো বিপদাপদ দূর করে দেয়া হয়, কিংবা ৩. পরকালে ওই পরিমাণ সওয়াব তার আমলনামায় অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হয়।
সুতরাং দোয়া প্রত্যাশিত কোনো বিষয় প্রাপ্ত না হলে মানুষের জন্য এমনটি মনে করা উচিত নয় যে, আমার দোয়া কবুল হয়নি, কিংবা আমার দোয়া বেকার ও নিষ্ফল হয়েছে। বরং দোয়া যদি তার আদব অনুসরণ করে হয়ে থাকে, তাহলে তা কখনও বেফায়দার হয় না। যার ফলাফল মানুষের জন্য তাই হয়, যা তার শেষ পরিণতিতে সুফল বয়ে আনে।
কেরামতিয়া মসজিদের নাম প্রসঙ্গে
মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ.) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দির উল্লেখযোগ্য সমাজ সংস্কারক। তিনি ওয়াজ-নসিহত করে মানুষকে হেদায়তের পথে আহবান করতেন। মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী ভারতের উত্তর প্রদেশের জৌনপুরে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর বংশধর ছিলেন। ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মপ্রচারের সুবাদে মাওলানা কারামত আলী (রহ.) নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, আসাম, রংপুর এবং আরও অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল সফর করেন। সফরকালীন অবস্থায় ১৮৭৩ সালে রংপুরে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে তার ইন্তেকাল হয়। এখানেই তাকে দাফন করা হয়। এখানে তার স্ত্রীর কবরও অাছে। তার নামানুসারে এই মসজিদের নাম কেরামতিয়া জামে মসজিদ রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০১৫
এমএ
অপার মহিমার রমজান
বাংলানিউজকে মাওলানা বায়েজীদ
রমজানে আল্লাহতায়ালা তার বান্দার আকুতি বেশি করে শোনেন
রমজান/কথোপকথন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।