ছোট বড় হাজারো দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে ইন্দোনেশিয়া। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দ্বীপের মালিক এ রাষ্ট্রটির আছে আরেকটি গৌরব।
হিজরি দ্বিতীয় শতকের শেষভাগে আম্মান, হাজারা-মাউত ও ইয়ামানের আরব ব্যবসায়ীরা নোঙর ফেলেন ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে। তাদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হলে, ইন্দোনেশিয়ার একদল প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আব্বাসি খলিফা হারুনুর রশিদের সঙ্গে দেখা করেন এবং ইসলামের বার্তা সঙ্গে নিয়ে দেশে ফেরেন। মূলত তাদের ইসলামগ্রহণের পর স্থানীয়দের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয় এবং দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে। হিজরি নবম শতকে জাভার প্রভাবশালী শাসক ও তার বংশের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করলে পুরো অঞ্চলে ইসলাম বিস্তার লাভ করে। তখন প্রতিবেশী দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোও ইসলামকে স্বাগত জানায়। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম জাভায় সুলতান হাসানুদ্দিন প্রতিষ্ঠিত ‘ব্যানথাম’ রাজ্যের ভূমিকা সব চেয়ে বেশি। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হারুন তুরনাথ- যিনি ইন্দোনেশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রকে ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত করেন- তাকে প্রতারণার মাধ্যমে হত্যা করে পর্তুগাল ইন্দোনেশিয়া দখল করে নেয়। সুলতান হারুনের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের পর ১৯৪৯ সালে নেদারল্যান্ডস-এর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি।
দীর্ঘদিনের খ্রিস্টীয় ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে স্বাধীন ইন্দোনেশিয়াকে দারিদ্র্য ও খ্রিস্টবাদের মতো ভয়াবহ সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে খ্রিস্টান মিশনগুলো খ্রিস্টধর্মের দ্রুত বিস্তার ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি নিজস্ব টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে তারা ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। ৫০ বছরে তারা মুসলিম জনসংখ্যাকে ৯৭% থেকে ৯০%-এ নামিয়ে এসেছে। ১৯৯৯ সালে খ্রিস্টান পূর্ব তিমুর ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীন হয়ে গেছে।
ইন্দোনেশিয়ায় চাঁদ দেখা নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস দেখা যায় না। খুব কম লোকই চাঁদ দেখতে বের হয়। চাঁদ দেখারে ব্যাপারে মানুষ ধর্মমন্ত্রণালয় এবং রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করে। তবে চাঁদ ওঠার সংবাদ প্রচার হওয়ার পর তাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদের পাশে কোনো খোলা জায়গায় একজন বিশাল ড্রাম বাজায় এবং সেখানে উপস্থিত হয়ে সবাই পরস্পরকে অভিনন্দন জানায়। সবাই সমস্বরে বলতে থাকে, আহলান ইয়া রমজান! মারহাবান ইয়া রমজান!!
ইন্দোনেশিয়ার পুরুষরা সাধারণত মসজিদে ইফতার করেন। ইফতারের পূর্বে তারা নিজ নিজ ঘরে তৈরি ইফতার নিয়ে মসজিদে একত্র হয় এবং সব ইফতার এক স্থানে জমা করে। সবাই বয়স ও অবস্থান অনুযায়ী ভাগ ভাগ হয়ে বসে পড়ে এবং এক সঙ্গে ইফতার করে মাগরিবের নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করে। ইফতার আয়োজনে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হলো- ‘আবহাম’ নামের পানীয় এবং খেজুর। খেজুরের সঙ্গে ‘কোলাক’ নামে এক প্রকার মিষ্টান্নও পরিবেশন করা হয়। এছাড়া তারা রাতের খাবারে ভাত, সবজি, মুরগি ও গরুর গোশত খেতে পছন্দ করে। ইন্দোনেশিয়ার অধিকাংশ মানুষ সেহরিতে অভ্যস্ত নয়। তারা রাতে ভারি খাবার গ্রহণ করে এবং ফজর পর্যন্ত ঘুমায়।
রমজানে ইন্দোনেশিয়ার মসজিদগুলো মুসল্লিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। মসজিদগুলোতে রমজানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় বিধি-বিধান ও কোরআন তেলাওয়াত শিক্ষা, কোরআন ও হাদিসের দরস হয়। সেখানে প্রচুর পরিমাণ মুসলিম অংশগ্রহণ করে। বিশেষত যুবকরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে সেখানে অংশগ্রহণ করে। স্থানীয় আলেমগরাই এ ধর্মীয় কাজগুলোর নেতৃত্ব দেন। তবে কখনো কখনো দেশের বাইরের কোনো কোনো বুজুর্গ ব্যক্তিও সেখানে উপস্থিত থাকেন। ইন্দোনেশিয়ার যেসব আলেম দেশের বাইরে থাকেন বা শহরগুলোতে বাস করেন, রমজানে তারা দেশে ফিরে আসেন এবং এক মাস দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধর্মীয় শিক্ষা ও দাওয়াতের কাজ করেন।
ইন্দোনেশিয়ার অধিকাংশ মসজিদেই খুব গুরুত্বের সঙ্গে খতম তারাবি হয় না। বরং মুসল্লিদের অবস্থা বুঝে কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। তারাবির নামাজের ফাঁকে ফাঁকে ধর্মীয় আলোচনা হয়। অধিকাংশ মসজিদেই প্রত্যেক দুই রাকাত নামাজের পর কিছু দোয়া ও জিকির করা হয়। বিশেষত রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করা হয়। পুরুষের মতো নারীরাও মসজিদে তারাবির জামাতে অংশগ্রহণ করে এবং তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়।
ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমরা রমজান মাসকে সুসম্পর্ক গড়ার মাস বলে গণ্য করেন। এ মাসে পরস্পরের ঝগড়া ও বিবাদ মিটিয়ে দেয়া হয়। সম্পর্কের দূরত্ব ঘুচিয়ে সবাই নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করে। প্রত্যেক মসজিদে ঝগড়া বিবাদ মিটিয়ে দেয়ার জন্য বৈঠক হয় এবং সামাজিক উদ্যোগে সব কলহ মিটিয়ে ফেলা হয়। স্থানীয় ভাষায় এই বৈঠককে ‘হালাল বা-হালাল’ বলা হয়।
ইন্দোনেশিয়ার মানুষ স্বভাবতই ধর্মপরায়ণ। তারা ধর্মীয় জীবনযাপন এবং সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। রমজানে তাদের ধর্মীয় স্পৃহা আরও বৃদ্ধি পায়। ইবাদত, বন্দেগি ও কল্যাণমূলক কাজে তখন প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী দান করে। গরিব ও দুস্থ মানুষের মাঝে খাদ্য ও কাপড় বিতরণ করে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মন্দ ও পাপ কাজ পরিহার করা হয়। রমজানে নামাজ পরিহার ও পাপের কাজ করাকে সামাজিকভাবে খুবই লজ্জাজনক মনে করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘন্টা, জুলাই ০৯, ২০১৫
এমএ/