পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়ে গেছে। মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, বরকত ও নাজাতের মাস রমজান।
এ মাসের মাঝে কিছু রহমত এমন, যেগুলো প্রত্যেক মুসলমানই জানে এবং আমলও করে। যেমন এ মাসে রোজা রাখা ফরজ, আর মুসলমানদের রোজা রাখার তাওফিকও হয়ে যায়- আলহামদুলিল্লাহ। তারাবিহ সুন্নত’ -এ বিষয়টি কোনো মুসলমানের অজানা নয়। আর তাতে শরিক হওয়ার সৌভাগ্যও তাদের ভাগ্যে জুটে যায়। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি সকলের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে চাই। সাধারণত মনে করা হয়, রমজানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এ মাসে শুধু দিনের বেলা রোজা রাখা আর রাতে তারারিহ পড়া। ব্যস, আর কোনো বৈশিষ্ট্য যেন এ মাসের জন্য নেই। নিঃসন্দেহে এ দু'টি ইবাদত এ মাসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কথা শুধু এ পর্যন্তই নয়; বরং প্রকৃতপক্ষে রমজান শরিফ আমাদের নিকট আরো কিছু প্রত্যাশা করে।
কুরআন মজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন: অর্থ- মানব ও জিন জাতিকে আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াত, আয়াতঃ ৫৬)
এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা মানবসৃষ্টির মৌলিক উদ্দেশ্য বর্ণনা করলেন এভাবে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, যদি মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য একমাত্র এবাদত করাই হয়, তাহলে শুধু এ উদ্দেশ্যে মানবসৃষ্টির কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ, কাজটি তো ফেরশতারা দীর্ঘদিন যাবৎ করেই আসছিল। নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলার ফেরেশতারা তার ইবাদত করে আসছিল। তবে তাদের ইবাদত আর মানুষের ইবাদতের মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কারণ, ফেরশতারা তাদের উপর আরোপিত ইবাদতের বিপরীত কোনো কিছু করতে পারে না। তারা ইবাদত ছেড়ে দিতে চাইলেও ছাড়তে সক্ষম নয়। গুনাহ করার সম্ভাবনাটুকুও আল্লাহ তাআলা তাদের থেকে খতম করে দিয়েছেন। তাই তাদের ক্ষুধা লাগে না, পিপাসা অনুভূত হয় না, জৈবিক চাহিদা পূরণের ইচ্ছা জাগে না। এমনকি গুনাহ করার কুমন্ত্রণাও তাদের মাঝে উদিত হয় না। গুনাহ করতে চাওয়া কিংবা গুনাহের প্রতি হাত বাড়ানো তো অনেক দূরের কথা। এ জন্য তাদের ইবাদতের কোন প্রতিদান বা সওয়াব আল্লাহ তায়ালা রাখেননি। কারণ, গুনাহ করার যোগ্যতা না থাকার দরুণ গুনাহ না করাতো বিশেষ কোনো কৃতিত্ব নয়।
সুতরাং ফেরেশতারা যদি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাবার না খান, তবে এটা কোন বড় কিছু নয়। কারণ তাদেরতো ক্ষুধাই নেই। কিন্তু মানুষ তো সৃষ্টি হয়েছে সকল প্রয়োজন নিয়েই। ‘মানুষ’ সে যত বড়োই মর্যাদাবান হোক না কেন, খানা-পিনা ও যাবতীয় চাহিদা থেকে মুক্ত নয়। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা এমন এক জীব সৃষ্টি করেছেন, যাদের ক্ষুধা অনুভূত হবে, পিপাসা নিবারণের প্রয়োজন হবে, যাদের অন্তরে জৈবিক চাহিদা জাগবে এবং গুনাহ করার সমূহ উপকরণও যাদের হাতে থাকবে, কিন্তু যখনই নাফরমানীর আকাঙ্ক্ষা তাদের মনে আসবে, তখনই তারা তাদের রব কে স্মরণ করবে এবং গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা করবে। তার প্রতিদান স্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত দান করবেন। যেহেতু তার অন্তরে রয়েছে গুনাহ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, গুনাহের বিভিন্ন উপকরণও তার সামনে বিদ্যমান। অথচ মানুষটি শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে, তার বড়ত্বের কথা ভেবে গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে, গুনাহের দিকে অগ্রসরমান কদমকে গুটিয়ে নেয় এবং তার অন্তরে এই আশা যে, যেন আমার আল্লাহ আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হন।
এ ধরণের ইবাদত করার সাধ্যতো ফেরেশতাদের নেই। তাই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে এ ধরনের ইবাদত করার জন্যই। সুতরাং এ মাসে সকলের উচিৎ সৃষ্টির মূল লক্ষ্যপানে ফিরে আসা। এগারো মাসব্যাপী আল্লাহ থেকে দূরে ছিলাম, দুনিয়ার চিন্তায় নিমজ্জিত ছিলাম। এই মাসে আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তার নৈকট্য অর্জন করা চাই।
এ মাসে ঝামেলামুক্ত থাকুন:
এ মাসে দুনিয়াবি ব্যস্ততা কিছুটা কমিয়ে দিয়ে দ্বীনি কাজে লিপ্ত থাকুন। যেহেতু মাসটি আল্লাহ দিয়েছেন ইবাদতের জন্য, সেহেতু বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগি করা। আল্লাহ তায়ালা এ মাসে নেক আমলের প্রতিদানকে অনেক গুণ বৃদ্ধি করে দেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে যে, এ মাসে একটি নফল ইবাদত প্রতিদানের দিক দিয়ে ফরজ এর সমতুল্য করে দেওয়া হয়। আর একটি ফরজকে ৭০টি ফরজ আদায়ের ন্যায় প্রতিদান দেওয়া হয়। সুতরাং যত বেশি সম্ভব এ মাসে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা চাই।
নিজ ঘনিষ্টজন ও মুসলমান প্রতিবেশীকে ইফতার করানো:
যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা সামর্থ্য দিয়েছেন যথাসম্ভব এ মাসে অন্য মুসলমান ভাইকে ইফতার করানো উচিত। কেননা যে ব্যক্তি অন্য কোনো মুসলমান ভাইকে ইফতার করাবে এটা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির পরওয়ানা হবে। প্রকাশ থাকে যে, ইফতার করানো দ্বারা উদ্দেশ্য এই নয় যে, খুব জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করে ভালো-মন্দ খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। বরং যার যতটুকু সামর্থ্য হয়, সেই অনুপাতে ইফতার করানোই যথেষ্ট। হাদিসে এসেছে, যদি কারোর একটি খেজুর দ্বারাও অপর কাউকে ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য থাকে, সে যেন একটি খেজুর দ্বারা হলেও অপর মুসলমান ভাইকে ইফতার করায় এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভ করে।
কুরআন তেলাওয়াত করা:
এ মাস কুরআন নাজিলের মাস। আল্লাহ তাআলা কুরআন নাজিল করার জন্য এই মাসকে নির্ধারিত করেছেন। সুতরাং এই মাসে যথাসম্ভব কুরআনের হক আদায় করার চেষ্টা করা। মাস জুড়ে কমপক্ষে ০৩ (তিন) খতম কুরআন তেলাওয়াত করা। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে কমপক্ষে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত অবশ্যই সম্পন্ন করা। আর মনে রাখতে হবে যে, কুরআন আল্লাহর কালাম। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহ তাআলার কালাম দ্বারা যতটা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়’ ততোটা অন্য কোনকিছু দ্বারা সম্ভব হয় না।
এ মাসে গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখুন:
গুনাহমুক্ত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হওয়া মুমিন জীবনের সফলতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কেননা গুনাহের কারণে মানুষের অন্তর থেকে নেক আমলের প্রভাব দূর হয়ে যায়। গুনাহের কারণে মানুষ নেক আমলের উত্তম প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ গুনাহ তার নেক আমলগুলোকে কলুষিত করে দেয়। সুতরাং সর্বাবস্থায় গুনাহ ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা। অন্য মাসেও তা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মাহে রমজানে এর গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পরিপূর্ণ তাওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়