ঢাকা : ২০১০ ও ২০১১ সালে দেশের দুই শেয়ারবাজারে যে ধস নামে তা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। মূলত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি তানজিল চৌধুরী।
সম্প্রতি বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন তানজিল চৌধুরী। পাঠকদের জন্য তার চম্বুক অংশ নিচে তুলে ধরা হলো।
বাংলানিউজ: সম্প্রতি বাজারে বেশ উত্থান-পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর পেছনে প্রধান কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
তানজিল চৌধুরী: ২০১০-২০১১ সালে মার্কেটে তারল্য অনেক বেশি ছিল। সে সময় বাজার সংশ্লিষ্টরা, বিশেষ করে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা, বলতে থাকেন বাজার কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে বাজারে ধস নামতে পারে। এ ধরনের ম্যাসেজ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি করে। এ ধরনের তথ্য ছাড়া আমি তখন বাজার হঠাৎ পরে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখিনি। মূলত বাজার সম্পর্কে তাদের সংশয় প্রকাশ করায় বিনিয়োগকারীরা অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কয়েকটি নির্দেশনাও বাজার পতনকে ত্বরান্বিত করে।
বাংলানিউজ: কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসি-এর কোন নির্দেশনা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে?
তানজিল চৌধুরী: সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের লাগাম টেনে ধরেছিল। কারণ তখন পুঁজিবাজারে কয়েকটি ব্যাংকের বিনিয়োগ ছিল অনেক বেশি। তারপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও কয়েকটি নির্দেশনা আসায় তা পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি।
এছাড়া বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। যা আগে তারা করতো না। যেমন শেয়ার মূল্য ও মার্জিন ঋণের বিষয়ে। ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হওয়ায় পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করেও তা ফেরানো সম্ভব হয়নি।
বাংলানিউজ: ২০১০ সালের আগে শেয়ার দাম অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণ কী ছিল বলে আপনি মনে করেন?
তানজিল চৌধুরী: সে সময় আমাদের দেশে শিল্পকারখানায় তেমন বিনিয়োগ হচ্ছিল না। কারণ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সমস্যা ছিল প্রকট। তাই মানুষ শেয়ারবাজারকে আয়ের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে থাকেন। তাই তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। ফলে শেয়ারের মূল্য আকাশচুম্বি হয়ে যায়। এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে যখন একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হতে লাগলো তখন বাজারে ধস নামলো। সে ধসে এসব বিনিয়োগকারী লোকসানের ধাক্কা সামলাতে পারেনি। যা এখনও বিরাজমান।
বাংলানিউজ: শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতায় এখন কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
তানজিল চৌধুরী: বাজার স্থিতিলতায় এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা আস্থার সংকট দূর করা। অতীতে এ সংকট দূর করতে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু তা কাজে আসেনি। বিশ্বের অনেক দেশে শেয়ারবাজারে ধস নামে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও ধস নামলে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে কাজে লাগানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশে তা করা হয়নি। তাই প্রধানমন্ত্রীর একটি ঘোষণাই বাজারে এ আস্থা ফিরে আসতে পারে। প্রধানমন্ত্রী যদি বাজার সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করেন, তবে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারতো। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, স্টেক হোল্ডার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে আশ্বস্ত হতে পারলে বাজার স্থিতিশীল হবে।
বাংলানিউজ: বাজার স্থিতিশীল করতে বিএমবিএ-এর প্রস্তাব কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে?
তানজিল চৌধুরী: বাজার স্থিতিশীলতায় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী মার্কেট মেকারদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছিল। সেখানে বিএমবিএ-এর পক্ষ থেকে ২০টি সুপারিশ করা হয়েছি। যার মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মাত্র ৭/৮টি সুপারিশ রাখা হয়েছিল। তবে হাস্যকর বিষয় হলো বিএমবিএ যেগুলো দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের সুপারিশ করেছিল তা স্বল্পমেয়াদী করা হয়, আর স্বল্প মেয়াদীগুলো দীর্ঘমেয়াদী করা হয়েছে। তাই আমাদের অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। যদি করা হতো তাহলে বাজার স্থিতিশীল থাকতো।
বাংলানিউজ: মার্জিন ঋণ নীতিমালা পুঁজিবাজারকে কতটুকু প্রভাবিত করবে?
তানজিল চৌধুরী: এটা বাজারে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো যদি শেয়ার বিক্রি (মার্জিন কল) করে দিতে পারতো তবে সাধারণ বিনিয়োগকারী এত লোকসানে পরতো না। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিএসইসি-এর মাধ্যমে মার্জিন কল না করার মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি ইক্যুইটি হারিয়েছে। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল মার্জিন কল না করলে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। বিশেষ করে পুঁজিবাজারের জন্য বড় ধরনের একটা ফান্ড দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আমাদের সেরকম কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি।
বাংলানিউজ: পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ কতটুকু সার্থক?
তানজিল চৌধুরী: বাজার ধসের একবছর পর কোনো আলাপ আলোচনা ছাড়াই অর্থমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ঋণ দেওয়ার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ চাপিয়ে দেন। যেখানে অত্যন্ত কঠিন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। ফলে কোনো বিনিয়োগকারী তাতে এখনও পর্যন্ত তেমন আগ্রহ দেখায়নি। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো এ প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর প্রতিযোগী ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কাছে। ফলে আমরা বিনিয়োগকারীদের আহ্বান করলেও তাতে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাংলানিউজ: বাজার স্থিতিশীলতায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?
তানজিল চৌধুরী: বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সিংহভাগ মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বিনিয়োগ হয়ে থাকে। কিন্তু সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্টক ব্রোকারেজ, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একই কাতারে আনা হয়েছে। যা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বড় বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করেছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলে তারা বাজারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে।
বাংলানিউজ: বড় বিনিয়োগকারীদের বাজারে আকৃষ্ট করতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কী?
তানজিল চৌধুরী: মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বাজারে কোনো কোম্পানি সম্পর্কে রিপোর্ট করতে পারে না। ব্যাংকগুলো যদি একটি কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করে তা প্রকাশ করতে পারতো তাহলে বড় বড় বিনিয়োগকারীদের বাজারে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারি না। ফলে এক্ষেত্রে আমরা তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছি না।
বাংলানিউজ: বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এ মুহূর্তে বিএমবি-এর সুপারিশ কী থাকবে?
তানজিল চৌধুরী: এ পরিস্থিতিতে মার্চেন্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি খুবই সাধারণ। বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত কয়েকটি ইতিবাচক সংবাদ প্রয়োজন। যেভাবে কয়েকটি নেতিবাচক সংবাদের ফলে বাজারে ধস নেমেছিল। সেভাবে কয়েকটি ইতিবাচক সংবাদ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। যা একমাত্র পলিসি মেকারদের পক্ষেই সম্ভব।
বাংলানিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
তানজিল চৌধুরী: বাংলানিউজকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১৪