দরজা দিয়ে ঢুকতেই চক্ষু চড়ক গাছ, বাঁশের লাঠিতে ঝুলিয়ে রাখা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের হারিকেন! দুধাপ এগোই। উজ্জ্বল লাল ও কমলা রঙের দেয়াল, তাপমাত্রা ধরে রাখার কৌশল।
ম্যানেজারের বসার জায়গার পাশে রাখা সেই প্রাচীন আমলের সাদা কালো একটি টেলিফোন সেট। কাঁসিার বাটি, প্লেট, গ্লাস সাজিয়ে রাখা ছোট্ট শোকেসে। পাশের আরেকটা শোকেসে চামচ, চায়ের কাপ, গ্লাস, প্লেটের বিবর্তনের নিদর্শন। ১৮ শতকে এসব কাপ, গ্লাস, চায়ের কাপ, প্লেটের আকার কেমন ছিল, ১৯ শতকে এসে সেগুলো কেমন হয়, আকার-আকৃতি-ডিজাইন পরিবর্তন হয়ে ২০ শতকে তাদের অবয়ব, সবশেষ ২১ শতকে এসে এই রেস্টুরেন্টে যে কাপ-পিরিচ দেওয়া হচ্ছে, এগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
বিকালের স্ন্যাকস ও কফি বিরতিতে আমরা এবার আল্লা ল্যান্টরনা রেস্টুরেন্টে। নোভি সাদের ডুনাভস্কা এলাকায় এটি। বাইরে একে তো বৃষ্টি, সেই সঙ্গে তাপমাত্রা শূন্যের ঘর ছুঁই ছুঁই। রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। রুম হিটারের কারণে ভেতরের পরিবেশ বেশ উঞ্চ। দূরের টেবিলে অন্য সবাই, আমি বসি ক্রিভোর সঙ্গে। সিকিউরিটি টিমের সবাই ঢক ঢক করে বিয়ার গলায় ঢেলে নেন। কারো গ্লাসে ভদকা, কেউ বা রেড ওয়াইনে ঠোঁট ভেজাচ্ছেন। ক্রিভোও সবার সঙ্গে গল্পে মত্ত। আমার দিকে তাকায় সে, ইশারা করে ড্রিঙ্কসের বোতলে। মাথা নেড়ে না বলি। এক কাপ ক্যাপাচিনোতেই সন্তুষ্টি আমার।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন-ন্যামের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সম্মেলন। এই সম্মেলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের আমি একজন সদস্য। সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে দেখার আয়োজন। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিক্ষাব্যবস্থাসহ নানা ক্ষেত্রে সার্বিয়ার অবস্থান তুলে ধরতেই ঘোরাঘুরির এই কর্মসূচি। ট্যুর গাইড, গাড়ি, নিরাপত্তা-স্বাগতিক সার্বিয়ার ব্যবস্থাপনাতেই সব। আমাদের টিমের সমন্বয়ক দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি মিলিচা ক্রিভোকাপিচ।
ছোট্ট রেস্টুরেন্ট। ভেতর ও বাইরে মিলিয়ে বড় জোর ৩০ জনের বসার চেয়ার রয়েছে। রেস্টুরেন্টের ডেকোরেশন ও ইন্টেরিয়র ডিজাইন নজর কাড়ার মতো।
উজ্জ্বল দেয়ালে রয়েছে অন্তত তিন শতক আগের আঁকা চিত্র যেমন, তেমনি হাল আমলের আধুনিক আর্টও রয়েছে। সাদাকালো দৈনিক পত্রিকার ডিজাইনে চেয়ারের সোফার কাপড়। রেস্টুরেন্টের একপাশে ব্লেজার রাখার স্ট্যান্ড, পাশেই কম্বলের স্তুপ। ঠাণ্ডা লাগলে এসব কম্বল ব্যবহার করা যায়। অথচ এয়ার ফ্রান্সের মতো ফ্লাইটেও যাত্রীদের জন্য কোনো কম্বল ছিল না। রেস্টুরেন্টের বাইরের দেয়াল সাজানো কয়েকপ্রকার লতাপাতার গাছপালা দিয়ে। এসব লতাপাতার মাঝে মাঝে রয়েছে খেজুর গাছও। এটি অবাক করার মতো। আর মজার আরেকটি বিষয়, রেস্টুরেন্টের একপাশে টেবিলে রাখা দৈনিক পত্রিকা আর বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ম্যাগাজিন। চাইলে বিনামূল্যে কেউ নিয়ে পড়তে পারেন, বগলদাবা করে বাসাতেও নিতে পারেন। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের বেচারা সাংবাদিক নাজমুস সাকিব, কাছাকাছি এমন রেস্টুরেন্ট পেলে প্রতিদিন সকালে ঢুঁ মারতেন। সুদুর এই সার্বিয়াতেও বাংলাদেশি খেজুর গাছেরও দেখা মেলে! বারবার খেই হারিয়ে ফেলছিলাম, পুরান ঢাকার কোনো রেস্টুরেন্টে বসে আছি কি না!
কফি শেষ করে বাইরে বের হই। রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়াই। ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর শীতল হয়ে ওঠে, সঙ্গে মনটাও। জেনেভায় সাগর পাড়ে বসেছিলাম। ঠাণ্ডার মধ্যে বাতাস এসে শীতল আবেশে জমিয়ে দিচ্ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে কোনো কাঁপুনি অনুভব করিনি। যেন এটারই দরকার ছিল। বহুদিনের উষ্ণ হৃদয়ে যেন একপশলা ঠাণ্ডার অভাব ছিল বহুদিনের। জেনেভার মতো নোভি সাদেও সেই একই অনুভূতি। অপরিচিত সড়কে দাঁড়িয়ে অচেনা আকাশের নিচে আমি ঠাণ্ডায় ভিজতে থাকি। জীবনবোধের ভাবনা আমায় গ্রাস করে।
এই যে, গত তিনবছর ধরে সরকারের ছোটোখাটো একটা পদে চাকরি করছি। আমার কাছেই কত মানুষের প্রত্যাশা! মন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করি বলে, মন্ত্রীর ছায়ায় আমারও না কি অসীম ক্ষমতা! চাকরিতে নিয়োগ, প্রমোশন, ট্রান্সফার, স্কুল-কলেজে ভর্তি, হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়া, প্রত্যাশিত মিশনে পোস্টিং- কত কিছুই না কি আমি ইচ্ছে করলেই পারি! এসব থেকেই ভাবনা আসে জীবনের সময়সীমার। পরিচিতি পর্বে যখন কেউ বলেন, তিনি কততম বিসিএস থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত, তখনই তার আয়ুস্কালের একটা ধারণা মনে চলে আসে।
একজন মানুষ ব্যতিক্রম না হলে বড়জোর ৩০ বছর চাকরি করতে পারেন। ৬০ বছর বয়সের পর আসে অবসরের পালা। এর পর, কেউ অন্য কিছুতে ব্যস্ত থাকেন। বেশিরভাগের শরীরে ভর করে জটিল নানা ব্যধি। গড় আয়ুর হিসেব করলেও আমাদের জীবনরথ থামে ৭৩ বছর বয়সে। আর ৪০ বছর পর থেকে কমতে থাকে খাবার চাহিদা, হ্রাস পেতে শুরু করে জৈবিক আকাঙ্খা। শুধু লালসা বাড়তে থাকে নেতৃত্বের, অর্থকড়ির, পদপদবির। এর মধ্যে যেকোনো সময়ে যদি নিভে যায় প্রাণপ্রদীপ, অর্থহীন হয়ে যায় দুনিয়ার সব কিছুই। পেছনে পড়ে যায় পরম আত্মীয়রাও। কেন তাহলে আমাদের এত ছোটাছুটি।
অথচ সব ধর্মেই তো জীবনের অপর অধ্যায়ের একটি সুস্পষ্ট বর্ণনা দেওয়া আছে। আমাদের নজর কেন সেই দিকে নিবিষ্ট থাকে না? কেন আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি না? আমার আত্মা শান্ত হতে শুরু করে, প্রশান্তি আসতে শুরু করে হৃদয়ে। ভাবনায় ছেদ পড়ে শ্রীলঙ্কান মিসেসের ডাকে। ‘এক্সমিউজ মি ইমদাদ, আমার কয়টা ছবি তুলে দেবে?’
দাঁতের ওপর দাঁত পড়ে যায়। রি রি করে ওঠে ইন্দ্রিয়। নিয়ন্ত্রণ করি। হাসিমুখ করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ি। কয়েকটা ছবি তুলে দিই। নোভিসাদেও সড়কে ন্যূনতম চারটা লেন। এদের মধ্যে আবার রয়েছে জরুরি এক্সপ্রেসওয়ে লেনও। চওড়া ফুটপাতের পাশে সাইকেল বে, প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে হুইল চেয়ারে চলাচলের জায়গাও। সবাই দ্রুত হাঁটছে। যেন জীবনের পথ পাড়ি দেওয়ার কত তাড়া তাদের।
বাচ্চার হাত ধরে মায়ের দৌড়, জড়াজড়ি করে প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের হাঁটাহাটি, উচ্ছ্বল তরুণ-তরুণীর দ্রুতগতিতে সাইকেলের পেডেল ঘুরানি, বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কোনোমতে পথ পাড়ি দেওয়ার যুদ্ধ- দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি। খুঁজে ফিরি জীবনের দর্শন। ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচাতে মায়ের বুকের ভেতরে শিশুকে আগলে রাখার প্রচেষ্টা দেখি। ভাবি, পৃথিবীর সবজায়গায় বুঝি জীবনের মানে একই। সব ঘড়িতে একই সময়, সব সন্তানের জন্য মায়ের প্রেম, বাচ্চাদের সুখে রাখতে বাবার সংগ্রাম, সন্তানদের বাউন্ডেলেপনা-ঘাউরামি। প্রেমিক- প্রেমিকার রোমান্টিকতা-পাগলামি। পদপদবির অবস্থান নিশ্চিত করতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে হীন ষড়যন্ত্র, কুটিলতা- সব আমলে সব সমাজেই ছিল। আমেরিকা থেকে আফগানিস্তান, সৌদি আরব থেকে সাইবেরিয়া- দুষ্টু লোকের দুষ্টমির বৈচিত্রতা সবখানেই শান্তি নষ্ট করে। রয়েছে ক্রিয়েটিভ গোষ্ঠীর সক্রিয়তাও। এসব নিয়েই বেঁচে থাকার অদম্য লড়াইয়ে ব্যস্ত সবাই।
খোলামেলা শহর। উঁচু ভবনের আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা নেই, সব ভবন মাঝারি- একই মাপের। বিশাল জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা শপিংমলগুলো। সড়ক, পার্কিং, খেলার মাঠ, আবাসিক এলাকা- সব জায়গায় খোলামেলা পরিবেশ। লোকজনের সংখ্যা কম। সড়কে ভিড় নেই, নেই যানবাহনের বাড়তি চাপ। শপিংমলেও দোকানগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা পরিমিত।
বিকাল তখন চারটা। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হই সবাই। দৌড়ে আসে ক্রিভো।
‘তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
আমাকে নিয়ে তার উদ্বেগ ভালো লাগে। এই উদ্বেগে কোনো ভালোবাসা নেই, নেই আত্মিক কোনো টান-অনুভব। এটা তার জব ডিউটির অংশ। তবুও আমার ভালো লাগে। বিবর্ণ এই সময়ে কতজনই বা আন্তরিকভাবে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করি আমরা? অথচ এই দায়িত্বের জন্য সরকার আমাকে নিয়োজিত করেছে, দিয়েছে অনেক রকমের সুযোগসুবিধা।
‘ট্যুর প্রোগ্রামে একটু পরিবর্তন হয়েছে। আমরা তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি না। সকলের গাড়ি পরিবর্তন হয়েছে। সঙ্গে থাকছে সিকিউরিটির একটি গাড়ি, যারা তোমাদের স্কট করে নিয়ে যাবে। তোমাদের ব্যাগগুলো নতুন গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আজই ছিল তোমাদের সঙ্গে শেষ দিন। আপাতত আর দেখা হচ্ছে না। ’
জড়িয়ে ধরে। হাতে হাত রাখে, চোখে রাখে চোখ।
‘ভালো থেকো ইমদাদ। ইউরোপে আবার এলে জানিও। দেখা হবে হয়তো। ’
নতুন ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেন। হোটেলের পথে রাস্তার দূরত্ব কমতে থাকে। বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। অনুভব করি একরাশ শূন্যতা। মনে হয়, কিছু একটা নেই। বুকের বাঁ পাশে কি ব্যথা অনুভব হতে শুরু করে, চিনচিনে ব্যথা?- বুঝতে পারি না।
শীতের বিকালে রোদের লুকোচুরি টের পাই। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়ে গাড়িতে। রোদের সোনালী আলোতে তৈরি হয় গাড়ির ছায়া, ক্ষণস্থায়ী। গাড়ির গতির সঙ্গে পেছনে পড়ে রয় দানিউবের সবুজ তীর, স্মৃতি হতে থাকে নোভি সাদের খোলামেলা চত্ত্বর। সোনালী কেশের ক্রিভোও কি স্মৃতি হয়ে যাবে?