লোভা থেকে ফিরে: ঝরা পাতার দিন আসার আগেই ছুটছিলাম লোভার লোভে। যেতে যেতে প্রকৃতির সব অমায়িক ফ্রেম আমাদের ব্যাকুল করে তুলছিলো।
সিলেটের কানাইঘাট থেকে নৌকায় কিছুদূর যাবার পরই পেছনের পাহাড় সারি স্বাগত জানায় তার মনলোভা সৌন্দর্য দেখিয়ে। কড়া রোদ পেরিয়ে চিক চিক করা সুরমা নদীর জল মাড়িয়ে আমরা তখন পথ ধরেছিলোভার।
সিলেটের উত্তরপূর্ব এলাকা জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারত বাংলাদেশ ঘেঁষে সুরমা গেছে সিলেট শহরের দিকে। আর আমরা সুরমা পেরিয়ে কানাইঘাট উপজেলার মূলাগুল হয়ে ছুটছি লোভা নদীর কূলে। লোভা কানাইঘাট উপজেলার উত্তর পূর্বদিকের শেষ সীমান্ত। এরপরেই ভারত।
লোভার পরই ভারতের যে অংশ সেটা মেঘালয় আর আসামের দুটো রাজ্যেরই সীমানা। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্য তখন আলো ফেলেছে পূর্বের লোভার স্রোতে। সৌখিন আলোকচিত্রী রেজওয়ান তখন যেন খুঁজে পেলো নতুন কিছু ফ্রেম। ফ্রেমবন্দি হতে থাকলো একের পর এক প্রকৃতি, আর তার রূপ-অপরূপ সঙ্গে আমরাও। জাফলং আর বিছনাকান্দির মতো এখানেও আছে দুই পাহাড়ের ঝুলন্ত মিলন সেতু।
লোভার এই ঝুলন্ত সেতুটি ভারতের সীমানায়। অবশ্য সড়কপথে লোভায় যেতে ব্রিটিশ আমলের ছোট একটি ঝুলন্ত সেতু পাওয়া যায়।
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভা জায়গাটি গতানুগতিক কোনো পর্যটন কেন্দ্রে নয়। তবে একটু অন্য রকম মনলোভা সৌন্দর্য যে কাউকে মোহিত করবে।
এখানকার নীরব প্রকৃতি মনের জানালা খুলে ভাবতে বসিয়ে দেবে। প্রশান্তিভরা হৃদয়ে এনে দেবে এক টুকরো শান্তি। নীরবতায় লোভার ঢেউ দোল খায় পাহাড়ের কিনারায়। পাহাড়ি ঝরনা-নালার পানি লোভা নদীর উৎস।
লোভা নদী ধরে যতই এগুনো যায় ততই মনে হয় অজানা পাহাড়ের কোনো এক সরু বাঁকে হারিয়ে যাচ্ছি। লোভার অদূরে মূলাগুলে চা-বাগানের একটি পুরনো বাংলোতে ভ্রমণপিপাসুদের থামিয়ে দেবে।
সুনসান নীরবতার বাংলোটি অদ্ভুত। খড় আর কাঠের তৈরি এরকম আদলের বাংলো সিলেটে আর দেখা যায় না। পাহাড়ি বাংলো বাড়িটির উপর থেকে ভালো করে পরখ করে নেওয়া যায় মেঘালয় ও আসামের সীমান্ত এলাকাগুলো। বাড়ির উপর থেকে দৃষ্টি সমতলে গেলেই দেখা যায় লোভা নদীর জলধারা। আরও দেখা যায় সুরমার দূরন্ত ছুটে চলা।
লোভাছড়া চা-বাগানের একাংশের মালিক জেমস ফারসুগুন এই বাড়ির বাসিন্দা।
বাংলোতে তিনি একাই বসবাস করেন। প্রকৃতিপ্রেমী যে কারও বাড়িটি প্রথম দেখাতেই পছন্দ হবে। প্রকৃতির সঙ্গে মিশেল ঘটিয়ে বাড়িটি চারপাশ সাজানো। কয়েকশ’ প্রজাতির গাছালি ফলমূলে ভরা এই বাংলো বাড়ি।
বাংলোতে যাওয়ার পথে যে স্থানে নৌকা ভিড়াতে হয় সেখানে আছে একটি বয়োবৃদ্ধ বট বৃক্ষ। এর বয়স স্থানীয়রা বলে একশ’র বেশি। শতবর্ষী বট বৃক্ষটির গোড়ায় বসিয়ে আমাদের ফ্রেমবন্দি করে নিয়েছে রেজওয়ান।
জানা গেলো, আশপাশের লোকজন ঘাটে নৌকা থেকে আসা যাওয়ার পথে এখানেই বসে বিশ্রাম নেন।
এই বটবৃক্ষ থেকেই যে পথ উঁচু পাহাড়ের দিকে গেছে সেটি পৌঁছে গেছে বাংলোতে। এ পথ ধরে মিনিটকয়েক হাঁটার পরই একটি ধ্বংসপ্রায় পুরাতান চা ফ্যাক্টরি। চা ফ্যাক্টরির সেকেলে গাড়ি আর কিছু যন্ত্রপাতি ছাড়া বাড়িটিতে আর কিছুই নেই।
লোভাছড়ায় তখন অনেক বিকেল। হেলে পড়া সূর্যের ঝিকিমিকি আলো ঝলমলে লোভা। প্রকৃতিপ্রেমী কেউ এখানে একবার এলে যাবার বেলায় আর একটু সময় থেকে যাওয়ার কথা ভাববেন নিঃসন্দেহে। আর সন্ধ্যায় চাঁদমাখা নদীর জলে খানিকটা পা ভিজিয়ে নিলেই হলো। তখন ঢাকা শহরের যানজট আর ধুলোয় ভরা নগরীকে সত্যিই অবাস্তব বলে মনে হবে।
এখানে রাত কাটানোর জন্য খোলা আকাশ ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেই। আর খাবার প্রশ্নে উত্তরটা হবে এমন যে নিজের উপর নির্ভর করুন। সাথে করে যা নিয়ে যাবেন তাই খাবেন। তবে ছড়িপাড়া বাজার ও মূলাগুল বাজারে কয়েকটি দোকানের দেখা পেলেও পেতে পারেন। তবে ভালো খাবার পাবেন না সেখানে।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে প্রথমেই যেতে হবে সিলেটে। সেখান থেকে কানাইঘাট উপজেলায় যেতে পারেন বাস ও সিএনজি অটোরিকশায়। কদমতলী টার্মিনাল ও সোবহানীঘাট থেকে কানাইঘাটের বাস চলাচল আছে। কানাইঘাট খেয়াঘাট থেকে নৌকায় যেতে হবে লোভাছড়া।
দুই ঘণ্টার নদীপথ যাত্রার পরই লোভার মনলোভা প্রকৃতি আপনাকে কাছে টেনে নেবে।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৪