লোকে বছর শুরু করে ঠাকুর দেবতার নাম দিয়ে আর আমরা শুরু করলাম জার্নি বাই ট্রেন দিয়ে। তাও সান্ত্বনা মিলত যদি মাধ্যমিকের ছাত্র হতাম।
বছরের প্রথম দিনটা যখন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে সুখনিদ্রায় বিভোর, তখন আমরা বায়ুচড়াদের দল হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে হাজির হলাম চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে। রেলের কয়েকজন সদাশয় কর্মকর্তার বদান্যতায় আগে থেকে পায়ের থুড়ি পাছার তলার কাঠের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তাই সিটের ওপর পা তুলে গুটিসুটি মেরে বসে গেলাম আঠারো উনিশজন মুসাফির। এই কাফেলার সদস্যরা বড়ো বিচিত্র। যে লোকগুলো আমাদের ট্রেন চালিয়ে এখান থেকে সেখানে নিয়ে যায় বা স্টেশনে স্টেশনে ফ্ল্যাগ উঁচিয়ে পথ দেখিয়ে দেয় তারাই এবার আমার সহযাত্রী। আর সঙ্গে যে আমার মত আরও গোটা কয়েক হাকুল্যা পার্টি ছিল না সেটা না ভাবা ভুল। সারাটা পথ রেল নিয়ে গল্প গুজব করতে করতে দুপুরে এসে নামলাম কমলাপুর স্টেশনে।
৮ নম্বর প্লাটফরমের কোণায় সিরাজ বাবুর্চির রেস্তোরাঁয় ভর পেটে খেয়ে নিয়ে উঠতে গেলাম সিল্ক সিটি ট্রেনে। এই প্রথম ব্রডগেজের ট্রেনে চড়ব। কত ভাবালুতা দু চোখে। কোচে উঠে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কী প্রশস্থ বগি। দেখতেও কত সুন্দর। কিন্তু ঘড়ি যত ছাড়ার সময়ের কাছাকাছি আসতে লাগল জনস্রোতের উগ্র রূপটা টের পেতে লাগলাম। ঈদের সময় ছাড়া পূর্বাঞ্চলের কোনও ট্রেনে এমন ভিড় হয় না। কিন্তু এখানকার প্রতিটি ট্রেনে বৃহস্পতিবার হলে নাকি এমন হয়। এতে তারা অভ্যস্ত। ইশ্, মানুষ কত অসহায়। কিছু বগি এসব ট্রেনে জুড়িয়ে দিলে মানুষ কতই না আরামে চলাচল করতে পারত।
মিনিট দশেক লেটে ছাড়ল ট্রেন। ট্রেনের জানালাগুলো অর্ধেক কাচে ঢাকা। তাই বাতাস চলাচল হয় না ঠিক মত। নেই পর্যাপ্ত পাখা। তাই বছরের শীতলতম মাসে আমরা ভ্যাপসা গরমে কাহিল হতে লাগলাম। আর ট্রেনের গতিও সে রকম। ব্রডগেজ ট্রেনের এক শ ছাড়িয়ে যাওয়া গতির ঝড়ের গল্পকে স্রেফ গলাবাজি মনে হলো। আমাদের এদিককার (মিটারগেজ) মেইল ট্রেন এর চেয়ে জোরে ছোটে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলল। এর মধ্যে তলপেট ফেটে যাওয়া জলের চাপ শুরু হলো। তিন চারবার সাহস করে দাঁড়িয়ে পড়লাম জল বিয়োগের আশায়। কিন্তু দুই কদম এগুতেই সাহসের বেলুন ফুশ হয়ে গেল। জনতার এই বিক্ষুব্ধ ঊর্মিমালা ভেঙে জয়ের বন্দরে ভেড়া আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। শেষমেশ যখন মনে হলো মরি কি বাঁচি এবার আমি ঝাঁপিয়ে পড়ব বিক্ষুব্ধ সাগরে, তখন ভিড় কিছুটা কমেছে। কারণ ট্রেন টাঙ্গাইল ক্রস করে ফেলেছে। ধাক্কা ধাক্কি করে বাথরুমে গিয়ে দেখি সেখানে ৭ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে। অগত্যা নিচে নামলাম। উপর থেকে শুনি যাত্রীদের হুংকার। ভাই সরেন...। তাকিয়ে দেখি সারি ধরে দাঁড়িয়ে ছাদের যাত্রীরা জল বিয়োগে ব্যস্ত। ত্যাগের শান্তি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। ট্রেন ছাড়ল। ঘুট ঘুটে অন্ধকারের মধ্যে আমরা বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু পেরুলাম। নিসর্গ উপভোগের মন আর কারও নেই। পথ কখন ফুরাবে সেই অপেক্ষা সকলের।
সাড়ে ন’টায় ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনে এসে পৌঁছাল ট্রেন। ট্রেন থেকে নেমে মনে হলো কী শান্তি। আর স্টেশনটাও খুব সুন্দর। পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি। একটা ভটভটি নিয়ে রওনা হলাম আমরা। হাসি ঠাট্টায় মুখরিত হয়ে উঠল চারদিক। কে যেন মন্তব্য করল সিল্কসিটি থেকে নাকি ভটভটি দ্রুত গতিতে ছুটছে। ফেরার সময় এটায় করে ঢাকায় গেলে মন্দ হয় না। একটু যেতে না যেতে রেলের এক খানদানি শহর উন্মোচিত হলো আমাদের সামনে। শৈশব কৈশোর কেটেছে রেল পাড়ায়। প্রতিটি রেল পাড়ার চেহারা প্রায় একই রকম। মনে হলো রাত বিরাতে ভটভটিটা ভুল করে আমাকে সেই শৈশবে নিয়ে এলো। ঈশ্বরীতে রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে আমরা রওনা হলাম পাকশীর পানে। পথে পড়ল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রস্তাবিত স্থান, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, উত্তরা ইপিজেড। লালন শাহ ব্রিজ আর হার্ডিঞ্জ ব্রিজকে দৃষ্টির সীমানায় রেখে আমাদের টমটম বাঁক নিলো ডানে।
ছিমছাম সাজানো একটা সাবেকী শহরে ঢুকে গেলাম আমরা। ঘড়ির কাঁটা যেন পলকে ঘুরে গেলো কয়েক শ বছর। আমরা এসে গেলাম সাহেব সুবাদের যুগে। চট্টগ্রামের রেল পাড়ার মত বিতিকিচ্ছিরি দশা হয়নি এখানকার। অপাপবিদ্ধ কুমারীর মত আপন যৌবনে যেন সেজে আছে পাকশী। সুন্দর একটা রেস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল আমাদের। দারুণ একটা ঘুম হলো নরম বিছানায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বেরুলাম। বন্ধের দিন বলে হয়ত লোকজন ছিল না অফিস পাড়ায়। রেস্ট হাউজের সামনে সুন্দর ফুলের বাগান। ছাঁটা ঘাসের লন। পাখির কলকাকলি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। হঠাৎ মনের মধ্যে ভ্রম জাগল—এ স্বপ্ন না বাস্তব। আমি কি ভুলে ভুলে স্বর্গের কোনও উদ্যানে ঢুকে পড়েছি! এখনই দেবপুরুষরা এসে জানতে চাইবে আমার পরিচয়। আমার সহযাত্রী ও সহকর্মী আব্দুর রহিমকে নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণে বেরুলাম। রেস্ট হাউসের সামনে পাকশী বিভাগের রেলওয়ে হেড কোয়ার্টার। নান্দনিক একতলা ভবনটির সামনে সুন্দর করে সাজানো বাংলা অঞ্চলে চলা প্রথম ট্রেন ও এর বগির একটা নমুনা। প্রশস্থ রাস্তা, পাশে বড়ো রেলের লাইন আর দূরে দূরে ছাতার মত মেলানো বিশাল বিশাল রেনটি—পয়সা খরচ করে লোকে হিল্লি দিল্লি যায়; কিন্তু এই নিসর্গের কাছে পৃথিবীর অনেক বড়ো টুরিস্ট স্পট মেকি মনে হয়।
সকালের নাস্তা সারলাম পাকশী রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। একটু পরেই চলে এলো আমাদের বাস। সঙ্গে এলেন বাংলাদেশে ট্রেন স্পটিঙের পথিকৃৎ এম. নাজমুল ইসলাম আর রেলওয়ের বাণিজ্যিক ক্যাডারের তরুণ কর্মকর্তা হাসিনা খাতুন। আমাদের ত্রিশ জনের দলটি রওনা দিল কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে। পথে পড়ল গড়াই নদী। কই নদী! শুধু চর আর চর। মিউনিসিপ্যালটির নালার মতো ক্ষীণ একটা জলের ধারা। আফসোসে মনটা ভারী হয়ে গেল। কুষ্টিয়ার মদনপুর মোড়ে এসে আমাদের সাথে যুক্ত হলেন রেলওয়ে ফেসবুক গ্রুপের ক্রিয়েটর রেলওয়ে বাণিজ্যিক ক্যাডারের কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান সাহেব। বলতে পারেন এই দলের পালের গোদা। তাঁর উদ্যোগেই এত কিছু। তাঁর নেতৃত্বে আমারা গেলাম শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠি বাড়ি। লোকের অত্যাচারে মনে হলো কুঠি বাড়ি শান্তিতে নেই। কুঠি বাড়ির স্থাপত্যের সাথে খাপ খায় না এমন সব স্থাপনা চারপাশে। আর হকারদের অরুচিকর অবস্থানের কথা নাই বা বললাম। কুঠি বাড়ি নিয়ে যে কল্পনা মনের ভেতরে ছিল তা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। কই প্রমত্তা পদ্মা। কই কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরষা...। কুঠি বাড়িটা খুব একটা বড়ো নয়। রুমগুলো আমাদের থাকার ঘরের মতই। কিন্তু চারদিকে হাঁটা আর দম নেয়ার প্রচুর জায়গা। বাথরুম অবশ্য খুঁজে পেলাম। অথচ আমাদের বর্তমানের ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে দেখা হয় কতটা বাথরুম আর বেডরুম রাখা হলো। দম টম নেয়ার ফুসরত কই।
কুঠি বাড়ি থেকে আমরা গেলাম লালন শাহ’র আখড়া। আখড়ার ভেতরটা সত্যিই দৃষ্টিনন্দন আর স্বস্তিদায়ক। কিন্তু পার্কিং প্লেসে লালনের যে ভাস্কর্যটা রাখা হয়েছে তা দেখে সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল। কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এটা বানাতে পারে বলে আমরা মনে হলো না। কুষ্টিয়া থেকে ফেরার পথে আমরা ঘুরে গেলাম শতাব্দী প্রাচীন কুষ্টিয়া পৌরসভা ভবন। যেখান ফ্রি ওয়াইফাই’র ব্যবস্থা করা হয়েছে পৌরবাসীর জন্য।
দুপুরে পাকশী রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবে ভুরিভোজ হলো। কথা ছিল পাকশীর বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মোশারফ হোসেন সাহেবের থাকার। তাঁর সম্মানেই এই আয়োজন। কিন্তু শেষমেষ দাপ্তরিক কাজে তা আর হয়ে ওঠে নি। বিকেল কাটল হার্ডিঞ্জ ব্রিজে। ১৯১২ সালে স্থাপিত এই ব্রিজটি পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত নাকি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেল ব্রিজ ছিল। সেই সীমাবদ্ধ প্রযুক্তির যুগে বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে সাহেবরা কী করে এই বিশাল স্থাপনটা গড়ে তুলল এই বিস্ময় ঘিরে ধরল আমাদের। মুগ্ধ নয়নে হার্ডিঞ্জ ব্রিজকে দেখে আর স্থপতি গেইল সাহেবকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিকেলটা কাটল। সন্ধ্যায় আবার আমরা ফিরে আসি রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবে। সেখানে সংক্ষিপ্ত একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংবর্ধনা দেয়া হয় সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের চিফ কমান্ডেন্ট ও রেলওয়ে ফেসবুক গ্রুপের সক্রিয় সদস্য মি. শাহ আলম এবং বাংলাদেশে ট্রেন স্পটিঙের পথিকৃৎ এম. নামজুল ইসলামকে। অভিনন্দন জানানো হয় গ্রুপের নববিবাহিত ৫ দম্পিতকে।
পরের দিন সাত সকালে উঠে আমরা সাগড়দাড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে বসি। দেড় ঘণ্টার আনন্দময় একটা ট্রেন যাত্রার মাধ্যমে আমরা দর্শনা হল্ট স্টেশনে পৌঁছি। সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিল তিনটি মাইক্রোবাস। সেই সব বাসে করে আমরা দর্শনা স্টেশনে যাই। বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে পুরনো এ স্টেশনে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের বদৌলতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু ঐতিহ্য সেই অক্ষত রূপেই রয়ে গেছে। আসলে কিভাবে ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটানো যায় তার শিক্ষা দর্শনা স্টেশন থেকে নেয়া উচিৎ। সেখানে পেয়ে গেলাম আধুনিক সুদর্শন এক স্টেশন মাস্টার সাহেবকে। লিয়াকত সাহেবের ঔদার্য্যে স্টেশনে মৈত্রী ট্রেনটি দেখার সৌভাগ্য হলো। সেখানেই দেখা পেয়ে গেলাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি খিলখিল কাজী’র আর তার মেয়ের।
সেখান থেকে আমরা গেলাম দর্শনা জিরো পয়েন্টে। মাথাভাঙা নদীর ঘা ঘেঁষে যেতে যেতে বিশ্বাস হচ্ছিল না ও পাশে আরেকটা দেশ। দর্শনা স্টেশনে দুপুরের খাবার সেরে আমরা রওনা দিলাম মেহেরপুরের দিকে। গন্তব্য স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজধানী মুজিব নগরে। মুজিবনগরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের মানচিত্র আর ভাস্কর্যগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। কিছুটা সত্যের অপালাপ বাদে পুরো কমপ্লেক্স খুবই উপভোগ্য মনে হলো। বিশেষ করে আম বাগানটা মুগ্ধ করেছে আমাকে।
এভাবে দুই দিন চক্করবাজি করে ৪ জানুয়ারি রাতের ট্রেনে উঠে পড়লাম আমরা। আগামী বছর এভাবে কোন চক্করে সবার সঙ্গে ফের দেখা হয়ে যাবে এই প্রত্যয়ে আবার ডুব দিলাম ভার্চুয়াল জগতে। চাইলে আমাদের আন্তর্জালিক চক্করবাজিতে যোগ দিতে পারেন যেকোন সময় আপনিও। কেয়ার অফ https://www.facebook.com/groups/b.railway/
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৫