ঢাকা: নেত্রকোনা, দেশর উত্তর-পূর্ব জনপদের একটি নাম। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে ১৫৯ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ লাগোয়া এ জেলা।
এর উত্তরে গারো পাহাড়, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ জেলা, পূর্বে সুনামগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলার অবস্থান। আগে বৃহত্তর ময়মনসিংহের মহকুমা হলেও ১৯৮৪ সালে পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা পায় নেত্রকোনা।
মগড়া, কংস, সোমেশ্বরী, ধনাইখালী প্রভৃতি নদী বিধৌত সাবেক কালীগঞ্জের বর্তমান নাম নেত্রকোনা। এ জেলায় রয়েছে ঐতিহাসিক ও পর্যটন আকর্ষণে মনোমুগ্ধকর স্থান। এবার থাকছে সেখানকার বিভিন্ন জায়গার খোঁজ-খবর...
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, বিরিশিরি
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার সুমেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি। সমতলসহ এ অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিশেষ করে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের গারো, হাজং সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার নানান নিদর্শন রয়েছে এখানে। আদিবাসী সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি প্রতিবছর এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।
সোমেশ্বরী নদী
বলা যায় এই নদী একটি ‘কয়লা’ খনি। রয়েছে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত বালু। সারা দিন নদী থেকে কয়লা ও বালু তোলে স্থানীয়রা। দিন শেষে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করে।
মেঘালয়ের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরী নদীর আদি নাম ‘সমসাঙ্গ’। প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য পর্যটকদের বেশ কাছে টানে।
টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ
এখানে রয়েছে কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে পরিচালিত টঙ্ক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। দুর্গাপুর বাজার হয়ে সোমেশ্বরী পার হয়ে বিজয়পুরের দিকে এগুলেই দেখা মিলবে এ স্মৃতিসৌধটি।
প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মনি সিংহের মৃত্যু দিবসে এখানে তিন দিনব্যাপী ‘মনি মেলা’ নামে লোকজ মেলার আয়োজন করে কমরেড মনি সিংহ মেলা উদযাপন কমিটি।
রাশমণি স্মৃতিসৌধ
রানীখং থেকে বিজয়পুরে সাদা মাটির পাহাড়ে যাওয়ার পথে বহেরাতলীতে আছে হাজং মাতা রাশমণি স্মৃতিসৌধ।
১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সংঘটিত কৃষক ও টঙ্ক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নেত্রী হাজং মাতা রাশমণি। তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে রাশমণি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে।
সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি
সুসং দুর্গাপুরের রয়েছে প্রাচীন জমিদারির ঐতিহ্যগত ইতিহাস। ইতিহাস বলে, ভারতের কান্যকুব্জ থেকে ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দ (৬৮৬ বঙ্গাব্দ) পূর্ব ময়মনসিংহের উত্তরভাগ ‘পাহাড় মুল্লুকে’ প্রচুর সফরসঙ্গী নিয়ে কামরূপ ভ্রমণের উদ্দেশ্য বর্তমান দশভূজা বাড়ির প্রাঙ্গণে অশোক বৃক্ষের নিচে বিশ্রামের জন্য যাত্রাবিরতি করেন অভিযাত্রী সোমেশ্বর পাঠক মতান্তরে সোমনাথ পাঠক।
এই ‘পাহাড় মুল্লুক’ ছিল ‘বৈশ্য গারো’ নামের প্রবল পরাক্রমশালী এবং অত্যাচারী এক গারো রাজার অধীনে। সোমেশ্বর পাঠক তাকে যুদ্ধে পরাস্ত করে সু-সঙ্গ অর্থাৎ ভালো সঙ্গ নামে এক সামন্ততান্ত্রিক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোমেশ্বর পাঠকই সুসঙ্গ বা সুসং রাজবংশের আদি পুরুষ।
তখন থেকেই সু-সঙ্গের সঙ্গে দুর্গাপুর যোগ করে এই অঞ্চলের নামকরণ হয় সুসং দুর্গাপুর৷ এক সময় দুর্গাপুর ছিল সুসং রাজ্যের রাজধানী। সোমেশ্বর পাঠকের বংশধররাই দুর্গাপুরে রাজবাড়ি তৈরি করেছিলেন।
বাংলা ১৩০৪ সনের ভয়াবহ ভূমিকম্পে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে বাড়ি ফের পুনর্নির্মাণ করা হয়। রাজবাড়িটি চারটি অংশে বিভক্ত। বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি, আবু বাড়ি ও দুই আনি বাড়ি।
১৯৫০ সালের প্রজাসত্ত্ব আইনে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের আগ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছর এ অঞ্চলে জমিদারি করেন সোমেশ্বরের বংশধররা। বর্তমানে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত বাড়িটি এখনও কালের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
সাধু যোসেফের ধর্মপল্লি
ওপারেই ভারত। মাঝে বিশালকার গারো পাহাড়। এরপাশেই রানীখং গ্রাম। এখানে আছে সাধু যোসেফের ধর্মপল্লি। ১৯১২ সালে রানীখং গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ ক্যাথলিক গির্জা।
বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড়
রাশমণি স্মৃতিসৌধ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে বিজয়পুরে আছে চীনা মাটির পাহাড়। যা সিরামিক শিল্পের প্রধান কাঁচামাল। পাহাড়গুলো থেকে চীনা বা সাদা মাটি সংগ্রহের ফলে সৃষ্ট ছোট ছোট পুকুরের মতো গভীর জলাধারগুলো পর্যটকদের মন কাড়ে।
রোয়াইল বাড়ি দুর্গ
বাংলার প্রাচীন শাসনকর্তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক স্থান রোয়াইলবাড়ি দুর্গ। ইতিহাষ বলে, এক সময় বাংলার সুলতান হুসেন শাহ, নছরত শাহ এবং ঈশা খাঁ’র অশ্বারোহী বাহিনীর ঠক ঠক শব্দে কেঁপেছে এই রোয়াইলবাড়ির মাটি। সে ইতিহাস আজও পুরোপুরি জানা না গেলেও তাদের অহংকার ও শৌর্য-বীর্যের সাক্ষী হয়ে এখনও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন দুর্গটি।
আরবি শব্দ ‘রোয়াইল’ অর্থ ‘ক্ষুদ্র অশ্বারোহী বাহিনী’। ‘রোয়াইলবাড়ি’র অর্থ ‘অশ্বারোহী বাহিনীর বাড়ি’। কালক্রমে রোয়াইলবাড়ি এখন একটি গ্রাম এবং ইউনিয়নের নাম।
জেলার কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। দুর্গের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বেতাই নদী। ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়ি দুর্গ রোয়াইলবাড়ি থেকে কাছেই।
হাওরের দেশ নেত্রকোনা
নেত্রকোনার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে হাওর-বাওড়। জেলার মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুড়ি, কলমাকান্দায় কম বেশি ৫৬ টি হাওর ও বিল আছে। শুষ্ক মৌসুমে হাওরে চাষাবাদ হলেও বর্ষা মৌসুমে পানিতে থইথই করে।
তখন এসব এলাকার একমাত্র বাহন হয় নৌকা। মোহনগঞ্জ শহর থেকে রিকশায় দিঘলাকোনা গিয়ে দেখা যায় সাগর সদৃশ পানির বিস্তৃত প্রান্তর ডিঙ্গাপোতা।
বর্ষা মৌসুমে ভাটি অঞ্চলের গ্রামগুলোকে মনে হয়ে ছোট ছোট দ্বীপের মতো। বাতাস আর হাওরে পানির ঢেউয়ের শব্দে মন ভরিয়ে দেয় প্রকৃতি মিশুক মানুষকে।
কীভাবে যাবেন
রাজধানীর মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে নেত্রকোনায় সরাসরি বাস সার্ভিস চলাচল করে। আছে ঢাকা-মোহনগঞ্জ আন্তঃনগর ট্রেনও। নেত্রকোনা সদর থেকে দুর্গাপুর যাবার বাস সার্ভিস আছে।
এছাড়া ঢাকার কমলাপুর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড থেকেও দুর্গাপুর ও মোহনগঞ্জের বাস ছাড়ে। ভাড়া পড়বে ১৮০-২৫০ টাকা।
কোথায় থাকবেন
নেত্রকোনার দুর্গাপুরে এখনও সেভাবে বিস্তার লাভ করেনি পর্যটন। সেজন্য ভালো কোনো আবাসিক হোটেল নেই। তবে দুর্গাপুরে থাকার জন্য ভালো ব্যবস্থা হলো ইয়ুথ মেন খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইএমসিএ-এর রেস্ট হাউস।
এখানকার তিনজনের কক্ষের ভাড়া ২০০ টাকা এবং একজনের কক্ষের ভাড়া ১৫০ টাকা। মোবাইল নম্বর: ০১৭৩১ ০৩৯ ৭৬৯।
এছাড়া এখানে ইয়ুথ ওমেন খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইডব্লিউসিএ পরিচালিত আরেকটি রেস্ট হাউস আছে। মুঠোফোন: ০১৭১২ ০৪২ ৯১৬।
হাওর ভ্রমণে গেলে মোহনগঞ্জ উপজেলা শহরে থাকতে হবে। এখানে থাকার জন্য কিছু আবাসিক হোটেল আছে। এরমধ্যে স্টেশন রোডে হোটেল শাপলা ও হোটেল পাঠান উল্লেখযোগ্য।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
বাংলাদেশ সময়: ০৪১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৫
এমএ