ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

নেপাল নিরাপদ

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও উর্মি মাহবুব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৫
নেপাল নিরাপদ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নেপাল থেকে: ‘নেপাল ইজ সেফ’ (নেপাল নিরাপদ) প্ল্যাকার্ড ঝুলছে দোকানে দোকানে। দু’টি শব্দ যেনো বদলে দেবে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে শুরু করে সবকিছু।

পর্যটকনির্ভর দেশটির ভয়াবহতার কথা জানা সবার। তাই অনেকটা বিমুখ পর্যটকরা। দেশের মানুষও শঙ্কিত কিছুটা। অনেকটা তাদের জন্যই এ প্ল্যাকার্ড।

ভূমিকম্পের কারণে দেশটিতে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে পর্যটকের আগমন।

এর প্রভাব ঠেকেছে স্বয়ম্ভূ মন্দিরের ভাসমান প‍ুতুলের দোকান থেকে বৌদ্ধমন্দিরে আনিতার সুবিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে।

বাদ যায়নি ব্রজেন গুরুজেনের থ্রি-স্টার হোটেল মানাং, সুশান্তের রেস্তোরাঁও। রক্ষা পায়নি গায়ে গা লাগিয়ে ঠেস দিয়ে থাকা ডিসকো বার ও স্পা দোকানগুলো।

চুটিয়ে ব্যবসা করতে থাকা ট্রাভেল এজেন্সি ও রেন্ট-এ কার ব্যবসায়ীদেরও চরম দুর্দিন যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কাঠমান্ডু শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বৌদ্ধ মন্দিরটি পুরোপুরি বৃত্তাকার। এর চারদিকে রয়েছে প্রায় ৪০ ফুট প্রস্ত ওয়ার্কওয়ে। আর ওয়ার্কওয়ে ঘিরে গড়ে উঠেছে কয়েকশো দোকান। বেশিরভাগই কাপড় ও নানা ধরনের শো-পিসের। রয়েছে মাটির খেলনা, ধর্মীয় উপাসনার ব্যবহৃত জিনিসপত্রও।

মন্দিরের দক্ষিণে রয়েছে আনিতার কাপড় ও বিভিন্ন শো-পিসের দোকান।
 
সুবিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটি পরিচালনার জন্য রয়েছেন দু’জন সেলসম্যান।

অনেকের মতো তার দোকানেও ঝুলছে ‘নেপাল ইজ সেফ’ লেখা প্ল্যাকার্ড।

প্ল্যাকার্ড টাঙানোর কারণ জানতে চাইলে আনিতা বলেন, পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয়দের মধ্যেও এখন অনেক ভয় কাজ করে। স্থানীয়রাতো বড় কোনো শব্দের কম্পন হলেই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়! নানা রকম প্রচারণার কারণে পর্যটক আগমন কমে গেছে। তাই তাদের জানান দিতে এই প্ল্যাকার্ড টাঙানো হয়েছে।

আনিতা জানান, তার দোকানে আগে দিনে ৩৫-৪৫ হাজার রুপি বেচাকেনা হতো। সেই দোকানে এখন দিনে ১৫ হাজার রুপি বিক্রি করা দায় হয়ে গেছে।
গত শুক্রবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ হাজার রুপি।

আনিতা বলেন, এখন তবু কিছুটা বেড়েছে। ভূমিকম্পের পর তিনমাস আরও বেশি খারাপ অবস্থা ছিলো। কিন্তু যা বিক্রি হয় তা দিয়ে সংসার চালানো দূরের কথা, দোকানের ব্যয় পরিচালনা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। মূলধন ভাঙিয়ে চলতে হচ্ছে।

আনিতাকে মাসে দোকান ভাড়া দিতে হয় ৪৫ হাজার রুপি। এর বাইরে রয়েছে দু’জন কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ বিল ও অন্য আনুষঙ্গিক খরচ।

বৌদ্ধ মন্দিরের উত্তরপাশে (আদিত্য হ্যান্ড ক্রাফটের সামনে) উদ্ধাপতিম সিংহার দোকানেও এই মন্দা। মাটিতে পাটি বিছিয়ে বাচ্চাদের কাপড় বিক্রি করেন মাঝ বয়সী এ লোকটি। ভূমিকম্পের আগে দৈনিক দুই থেকে ৩ হাজার রুপি বেচাকেনা করতেন। এখন ৩ থেকে ৫’শ রুপির বেশি বিক্রি হয় না বলে জানান তিনি।

কিন্তু তাকে মাসে এক হাজার রুপি ভাড়া ঠিকই দিতে হয়। থাকেন নিউ বস্তি এলাকায়। সেখানে একটি রুমের জন্য ভাড়া দিতে হয় সাড়ে চার হাজার রুপি।

২৫ এপ্রিল ভূমিকম্পের দিন দোকানেই ছিলেন উদ্ধাপতিম। তিনি বাম হাতের ইশারায় বৌদ্ধমন্দিরের সর্বোচ্চ মিনারটি (দশতলা সমান উঁচু হবে) দেখিয়ে বলেন, ওইটা দোলনার মতো দুলছিলো। পাশের দোকানঘরগুলোও দুলছিলো।
 
লোকজন দৌড়ে দোকান আর মন্দিরের মাঝের ফাঁকা স্থানে অবস্থান নেয়।

তিনিও দৌড়ে ফাঁকায় গিয়ে ঈশ্বরের নাম জপতে থাকেন।

তখন দুই মেয়ে শিবসা সিংহা, প্রসম সিংহা ও স্ত্রীর কথা বারবার মনে পড়ছিলো বলে জানান তিনি।

তার কোনো আবাদি জমি নেই। একমাত্র সম্বল এই ফুটপাতের দোকানের আয়। মন্দির এলাকার অন্যতম ক্রেতা হাজার হাজার পর্যটক। আর সেই পর্যটক কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কমে গেছে তার বিক্রি।

অনেক ক্ষতি হয়েছে এ বৌদ্ধমন্দিরটির। উপরের বেশকিছু স্থান ধসে পড়েছে।

এরই মধ্যে পুরোদমে শুরু হয়েছে সংস্কার কাজ। শিগগিরই শেষ হবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।

কাঠমান্ডু শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কয়েশো বছরের পুরনো স্বয়ম্ভূ মন্দির। পাহাড়ের উপর অবস্থিত নান্দনিক এ মন্দিরটির পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের একটি।

সেই মন্দিরটির প্রসাদ বিতরণ ভবনটির একটি দেওয়ালও ধসে পড়েছে।

অন্যদিকে পিস টেম্পল খ্যাত ভবনটির বড় বড় ফাটল হা হয়ে আছে। স্থাপনাটি রক্ষার জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা খুবই চমৎকার বলা চলে।

চারদিকে কয়েকশো পাইপ (নলকূপের পাইপ) লাগিয়ে কাঠের সাহায্যে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। এ মন্দিরেও পর্যটকের আগমন কম আশঙ্কাজনক হারে। যে কারণে সিরসা লখিন্দ্রর পুতুলের ব্যবসায়ও নেমে এসেছে মন্দা।

এখানেই শেষ নয়, হোটেল ব্যবসায়ীদের চরম দুঃসময় যাচ্ছে। কোনো কোনো হোটেলে ৫০ শতাংশ সিট ফাঁকা। মানাং হোটেলের ম্যানেজার হেম প্রসাদ ওঝা বাংলনিউজকে জানান, তাদের হোটেলে মোট ৬০টি রুম রয়েছে।

থ্রি স্টার মানের মানাং হোটেলে শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) মাত্র ২৯টি রুম বুকিং পাওয়া গেছে। যে কারণে মুনাফা দূরের কথা, পরিচালনা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

সেপ্টেম্বরে পর্যটকে গিজ গিজ করে কাঠমান্ডু। সেই সেপ্টেম্বর মাসে এই অবস্থা চিন্তায় ফেলেছে ডিসকো বার ও স্পা ব্যবসায়ীদেরও। যে ডিসকোতে প্রতি রাতে কমপক্ষে ৫শ দর্শনার্থীর আগমন ঘটতো, সেখানে মাত্র ৫০ থেকে ১শ দর্শনার্থীর দেখা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।

সব বিবেচনায় ‘নেপাল ইজ সেফ’ লিখে মন্দা অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণের আশা খুঁজছেন নেপালবাসী।

বাংলাদেশ সময়: ০৩১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৫
এসআই/ইউএম/এএ

** কাঠমান্ডুর সেবায় মুগ্ধ, কিন্তু ঢাকায়...!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।