গাড়িতে ২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে সেই গন্তব্যের ভেতরে ঢুকে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। ওপরে নীল আকাশ।
না ভেনিস নয়, সেই আদলে সাজানো শপিংমলের ভেতরটা-‘ভিলাজিও’। কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত বিশ্বখ্যাত অত্যাধুনিক শপিংমল। ভেনিসীয় শৈলীর অভ্যন্তরীণ সাজের সাথে বিশ্বসেরা ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল পণ্যের ভান্ডার আর বিশাল পরিসরের কেনাকাটা, বিনোদন ও খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। এই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্য হয়ে উঠেছে এই ভিলাজিও। প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার মানুষ আসেন এটি পরিদর্শনে।
গত মে মাসে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের উদ্বোধনী ফ্লাইটের অতিথি হয়ে যাওয়া হয় পারস্য উপসাগরের দেশ কাতারে। দোহা বেড়াতে গিয়ে কাতার সিভিল এভিয়েশন কর্মকর্তা খালিদ হোসেনের ‘সারপ্রাইজ ট্রিপে’ পেলাম মরুর বুকের এই ভেনিস নগরীর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
দোহা শহরের পশ্চিমের শেষ প্রান্তে দোহা স্পোর্টস সিটি এলাকাতেই ভিলাজিও। অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ইভেন্টের জন্য বিশ্বখ্যাত ক্রীড়াপল্লীটি। ঢোকার সময়ই চোখে পড়েছিল খলিফা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। ২০০৬ এশিয়ান গেমস, ২০১১ এফসি এশীয় কাপের পর ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের অন্যতম ভেন্যু। পাশেই দোহার সবচেয়ে উঁচু কাঠামো এসপিরি বা অলিম্পিক টাওয়ার। ২০০৬ এশীয় গেমসের অন্যতম মাইলফলক। গন্তব্য যখন ‘ভেনিস’ এগুলো দেখার লোভ সামলাতে হল। স্মৃতি ধরে রাখলাম সেলফিতেই।
খালিদ ভাইয়ের সাথে পা বাড়ালাম ভিলাজিওর ভেতরে। সামনেই অপেক্ষমাণ ‘গন্ডোলা’। ভেনিসের বিখ্যাত খেলো নৌকা। ভেনিস নগরীর খালগুলোতে চলাচল করে। শুরু করতে চেয়েছিলাম গন্ডোলা ভ্রমণ দিয়ে। জনপ্রতি ১০ কাতারি রিয়ালে একসাথে ৪ জন চড়তে পারে দেড়শো মিটারের এই যানে। কিন্তু মাঝি না থাকায় উঠতে পারলাম না। গো ধরেছিলেন বাংলানিউজের মাজেদুল নয়ন। অ্যাডভেঞ্চার যার নেশা। পরে চড়ার আশ্বাসে খাল পাড়ি দিয়ে এগোলাম সামনে।
নজরকাড়া ভেনিসীয় আবহে যতই এগোচ্ছি বাড়ছে বিস্ময়। টের পাচ্ছিলাম রোমাঞ্চকর অনুভূতি। ওপরে সিলিং আঁকা মেঘের নীল আকাশ; মনে হচ্ছে না কৃত্রিম। একটু পরপরই খাল পারাপারের ছোট ছোট সেতু এবং দুপাশে আলোকায়িত ল্যাম্পপোস্ট আর বাড়িঘরের আদলে দোকানপাট-রেস্তোরাঁ। সব মিলেই যেন কল্পনার ভেনিস।
খালিদ হোসেন দোহায় প্রবাসী সাড়ে ৬ বছর। পরিবার নিয়ে প্রায়ই আসেন ভিলাজিওতে। তার বর্ণনা আর মোবাইল ফোনে গুগল সার্চে চটজলদি জেনে নিলাম এই মলের আদ্যোপান্ত।
ইতালিয়ান ভিলাজিও মানে ভিলেজ, গ্রাম। ইতালীয় গ্রামের উপমা হয়ে গড়ে ওঠা এই শপিংমল কাতারের প্রাক্তন আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানির ছেলে শেখ জসিম বিন হামাদ বিন খলিফা আল থানির চিন্তার ফসল। তিনি স্পোর্টস সিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষকও। প্রথমে ক্রীড়াপল্লীর ধারণা দিয়ে শুরু হলেও, পরে রূপ নেয় সমন্বিত শপিংমলে। ২০০৬ সালে চালু হওয়া ভিলাজিওর মালিক কাতারের ধনকুবের আবদুল আজিজ মোহাম্মদ আল রাব্বানী। তিনি রাজপরিবারের এক সদস্যের মেয়ের জামাইও।
৩ লাখ ৬০ হাজার বর্গমিটারের আয়তনের বিশাল এলাকায় গড়ে উঠেছে ভিলাজিও। এর মধ্যে শপিংমল এলাকা ১ লাখ ৮৩ হাজার বর্গমিটার। যেখানে রয়েছে ২২০টি দোকান। সাথে আছে বিশাল বরফ রিঙ্ক, ইনডোর থিম পার্ক, বিলাসবহুল সিনেমাসহ বিনোদনের অসাধারণ সব আয়োজন। বাইরে আছে সাড়ে ৩ হাজার গাড়ি পার্কিং স্পট।
হুট করে আসা। তাই কেনাকাটার তেমন প্ল্যান কারো নেই। তারপরও খালের পাশের কয়েকটি দোকানে ঢুঁ মেরে দেখলাম। অবশ্য কালের কন্ঠের মাসুদ রুমি বরাররের মতো সোনার দোকানে থিতু হলেন। এর আগে দোহার যেসব শপিংমলে গিয়েছিলাম সোনার দোকানেই বেশি দেখেছি রুমি ভাইকে। হেতু ঘরের প্রিয়জনটিকে উপহার দিতে সুন্দর একখান সোনার চেইন। কিন্তু পছন্দের ডিজাইন মিলছে না। এখানকার আল মজিদ জুয়েলারিতে খুঁজলেন অনেকক্ষণ। পেলেন না। এগোলাম সামনে।
৪৯২ ফুট লম্বা খালের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু ‘ভায়া ডোমো’। দামি ব্র্যান্ড শপের জোন। চারদিকে সারি সারি দোকান, মাঝখানে বিশাল চত্বর। এত বড় যে দোকান বন্ধ রেখে বড়দের ফুটবল খেলার আয়োজন করা যাবে অনায়াসে। চত্বরের শেষ প্রান্তে সুন্দর ফোয়ারাটি দৃষ্টি কাড়ে সবার।
ইলুইস ভুইটন, ক্রিশ্চিয়ান ডিওর, গুচ্চি, ভ্যালেনটিনো, ডল্স গাব্বা বিশ্বের শীর্ষ বিলাসী ব্র্যান্ডের কি নেই এই জোনে। দু’এক শো-রুমে উঁকি-ঝুঁকি মারলাম। কেনাকাটার সাহস হলো না। দাম যে কেমন হবে জানা আছে, তার উপর পেট্রো ডলারের দেশ!
পরের যাত্রা বিনোদন জোনে। প্রথমে দেখা মেলে অলিম্পিক-আকারের স্কেটিং বা বরফ রিঙ্কটি। কাতারের দুটি আইস হকি রিঙ্কের একটি। প্রতিবছর এখানেই হয় কাতার আইস হকি লীগ এবং আঞ্চলিক ডেজার্ট কাপ টুর্নামেন্ট। ছোট বড় সবাই এখানে স্কেটিং করতে পারে, শিখতেও পারে।
রিঙ্ক পার হয়েই গন্ডোলানিয়া থিম পার্ক। ভিলাজিও বিনোদনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। ২২ হাজার বর্গমিটারের পার্কটিতে আছে ছোট-বড় সবার জন্য মজার সব বিনোদন আয়োজন। শিশুদের জন্য তো জন্য পুরেদস্তুর ওয়ান্ডারল্যান্ডই মনে হল। রোলারকোস্টার, বাম্পার কার, স্কাই লুপ, নানা ধরনের রোমাঞ্চকর রাইড, ড্রপ টাওয়ার, ট্রামপোলাইন, গো কার্ট রেসিং, অ্যারেড গেম, ১২ লেনের বোলিং অ্যালে আর ফোর-ডি থিয়েটারসহ অনেককিছু। ১০ থেকে ৫০ রিয়ালের মধ্যে এসবের মজা নেওয়া যাবে। সময়ের জন্য আমরা নিতে পারলাম না। চোখ জুড়িয়ে পা বাড়ালাম পরের গন্তব্যে।
ফুড কোর্ট। কেএফসি, ক্রিপসি ক্রিমি, ম্যাগডোনালস, স্টারবাকস, শেক শ্যাকসহ আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের ফাস্ট ফুডের সারি সারি দোকান। সাথে হরেক রকমের রেস্টুরেন্ট। ক্ষিদে নেই বলে দাঁড়ালাম না। চলে গেলাম এংকর স্টোর জোনে।
এই জোনে আছে বিশ্বখ্যাত তিনটি মেগা স্টোর। বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাইপার মার্কেট চেইন ফ্রান্সের কেরিফোর, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার নেতৃস্থানীয় ভার্জিন মেগাস্টোর এবং বৃটেনের মার্কস এন্ড স্পেন্সার। কেরিফোরে রয়েছে ১ লাখেরও বেশি পণ্যের বিশাল সম্ভার। হোম ইলেক্ট্রনিক্স থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, তরিতরকারি সহ সংসারের বাদ নেই কিছু। ভার্জিন মেগাস্টোরে সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, বই, সাংস্কৃতিক বিনোদন, গেমিং, ফ্যাশন, উপহার, খেলনাসহ নানা বিনোদন পণ্য। আর নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাক, প্রসাধনী এবং বিলাসী খাদ্য সামগ্রী মার্কস এবং স্পেন্সার স্টোরে। দেখলামই শুধু!
জিনিস যেটা ভাল দামও তার একটু বেশি। মানতে রাজি, কিন্তু এখানে তো অনেক বেশি। এমনকি দোহার অন্য শপিংমলগুলো থেকেও। সাধ্যের বাইরে, মানা সম্ভব নয়। ডেইলি স্টারের সামিউল শিমুলের ভালো পর্যবেক্ষণ ‘সৌন্দর্যের একটা দাম আছে না, বাড়তি সে কারণেই’। চকলেট আর হালকা কেনাকাটায় স্মারক করতে হল। বই আর সিনেমাপ্রেমী প্রথম আলোর শওকত হোসেন মাসুম কিন্তু তার শখ পূরণে কার্পণ্য করেননি। দুখানা বই হাতেই বের হয়েছিলেন শপিংমল থেকে। মাসুম ভাই কোন ফাঁকে কিনলেন খেয়াল করিনি। একেই বলে নেশা। তবে সময়ের জন্য আরেক নেশা সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হলেন তিনি। সুন্দর আয়োজন ছিল সেখানে। ১৩ পর্দার বিলাসবহুল মুভি থিয়েটার, যা কিনা কাতারের একমাত্র আইএমএক্স পর্দা।
শুধু শপিংমল ঘুরতেই দুই থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লেগে যায়। কেনাকাটা আর বিনোদনের মজা নিতে গেলে তো লেগে যাবে পুরো দিন। আমরা গিয়েছিলাম কম সময় নিয়ে। তাই দেখার আনন্দকেই স্মরণীয় করতে হল।
সময় স্বল্পতায় শেষপর্যন্ত আর গন্ডোলায় খাল ভ্রমণও হলো না। আফসোসের শেষ নেই নয়নের। তবে হাতছাড়া করেননি রিজেন্ট এয়ারওয়েজের সিইও লে. জেনারেল (অব.) এম. ফজলে আকবর এবং জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। ভেনিসীয় সৌন্দর্য দেখতে তারাও গিয়েছিলেন আলাদা দলে। ‘রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, ভেনিস যে নয় মনেই হয়নি’-এমন অনুভূতি তাদের।
চাঁদের কলঙ্কের মতো ভিলাজিও সৌন্দর্যেও দাগ আছে। লাল দাগ। ২০১২ সালের মে মাসে এখানে আগুনে মারা যায় ১৯ জন। যাদের ১৩ জনই বিদেশি শিশু। মলের শিমপাঞ্জি ডে কেয়ার সেন্টারে আটকা পড়ে ধোঁয়াতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় শিশুরা এবং তাদের চার শিক্ষক আর দুজন দমকলকর্মী। কর্মসূত্রে শিশুদের অভিভাবক আর শিক্ষকরা কাতারে থাকতেন। দুর্ঘটনার দায় পরে মল ব্যবস্থাপনার ওপর। মামলা চলে অনেকদিন।
৫ বছরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভিলাজিও, মরুর বুকের ভেনিস নগরী!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক