ঢাকা: হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পরবর্তী সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো। সরকারি নানা উদ্যোগের পাশাপাশি জনসাধারণের নানামুখী অংশগ্রহণে স্বল্প সময়েই জঙ্গি পরিস্থতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গিদের সক্ষমতা নস্যাৎ করে দিয়ে পুরো পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কথাও বলছিলেন সংশ্লিষ্টরা। এরমধ্যেই বিদায়ী বছরের শেষভাগে আলোচনায় আসে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’।
সংগঠনটির বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পারে, দেশের পার্বত্য অঞ্চলে কুকি-চিন নামে বিচ্ছন্নতাবাদীদের ছত্রছায়ায় নতুন এ জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বান্দরবানসহ আশে-পাশের এলাকার গহীন পাহাড়ে তারা সংগঠিত হচ্ছিলো।
এ জঙ্গি সংগঠনটির ডাকে সাড়া দিয়ে দেশজুড়ে অর্ধশতাধিক তরুণ ঘর ছেড়েছেন, যারা বিভিন্ন সময় তথাকথিত হিজরতের নামে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণে যোগ দেন। পার্বত্য অঞ্চলসহ দেশজুড়ে ধারাবাহিক অভিযানে সংগঠনটির বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকাভুক্ত ঘরছাড়া অর্ধশতাধিক সেই তরুণ।
কুমিল্লা থেকে বেশ কয়েকজন তরুণের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি ছাড়ার ঘটনার পর গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। ঘর ছেড়ে উগ্রবাদের উদ্দেশে বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার একটি দল ৪ তরুণকে উদ্ধারের পর ডি-র্যাডিক্যালাইজড করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
এরপর গত ৬ অক্টোবর মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকায় অভিযান চালিয়ে কুমিল্লাসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে নিখোঁজ ৪ জন তরুণ ও উগ্রবাদী সংগঠনের দাওয়াতি, তত্ত্বাবধান, প্রশিক্ষণ, আশ্রয় প্রদান ও অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত তিনজনসহ মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ১০ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ থেকে উগ্রবাদী সংগঠনটির দাওয়াতি ও অন্যতম অর্থসরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ ও নিরুদ্দেশ ৩ তরুণসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। বিভিন্ন সময়ে নিখোঁজ তরুণদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে পাঠানোর চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রদান করেন গ্রেফতাররা।
এরমধ্যে অক্টোবরে পার্বত্য অঞ্চলে যৌথ বাহিনীর সন্ত্রাসী বিরোধী সম্মিলিত অভিযান শুরু হয়। গত ২১ অক্টোবর রাঙামাটি ও বান্দরবানের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শূরা সদস্য সৈয়দ মারুফ আহমদ ওরফে মানিকসহ ৭ জন এবং পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের ৩ জনসহ ১০ জনকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ গ্রেফতার করে র্যাব।
এছাড়া, গত ৩ নভেম্বর রাতে কুমিল্লার লাকসাম এলাকা থেকে সংগঠনটির অর্থ বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক মুনতাছির আহম্মেদ বাচ্চু, হিজরত করা সদস্যদের সার্বিক সমন্বয় সুজন ও ইসমাইল হোসেন হানজালাকে এবং সামরিক শাখার ৩য় সর্বোচ্চ ব্যক্তি হেলাল আহমেদ জাকারিয়াকে গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ৯ নভেম্বর সংগঠনটির অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী ২ সদস্যসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করে বাহিনীটি।
সর্বশেষ গত ৪ ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও রাজধানীর গুলিস্তান এলাকা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। তারা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র দাওয়াতি, হিজরত করা সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাবধান, পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহসহ অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এদিকে, গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ডেমরা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির সক্রিয় ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। সিটিটিসি জানায়, তরুণদের নিখোঁজের পর তদন্তের ধারাবাহিকতায় কুমিল্লা থেকে হিজরতের উদ্দেশে বের হওয়া আবরারুল হককে মগবাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেশব্যাপী নিখোঁজের চাঞ্চল্যকর ঘটনার সঙ্গে জড়িত সংগঠনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা ডাক্তার শাকির বিন ওয়ালীকে রামপুরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ডা. শাকির ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র দাওয়া বিভাগের প্রধান ছিলেন।
গত ১৩ ডিসেম্বর ভোরে রাজধানীর ভাটারা এলাকা থেকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। এর আগে গত ৯ নভেম্বর জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের ছেলে ডা. সাদিক সাইফুল্লাহ ওরফে ডা. রাফাতকে এক সহযোগিসহ সিলেট থেকে গ্রেফতার করা হয়। ডা. রাফাত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সিলেট অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন।
সিটিটিসি জানায়, ডা. রাফাত আগে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য ছিলেন। তার চেষ্টায় বহু লোক এ সংগঠনে যোগ দেয়। পরে ডা. রাফাত নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াতে দলবলসহ যোগদান করেন। ডা. রাফাতের নেতৃত্বেই প্রথম ১১ জন বান্দরবানের কুকি চিন ক্যাম্পে হিজরত করে। ডা. রাফাতের সামগ্রিক কার্যক্রমে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল। এর ফলে জামায়াতের আমিরকেও গ্রেফতার করা হয়।
এ বিষয়ে সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনকে নিয়ে আমরা নিরাপত্তার শঙ্কা দেখছি না। তবে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। সিটিটিসিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা রয়েছে। আশা করছি কথিত হিজরতের নামে যারা ঘর ছেড়েছে তাদের বেশ কয়েকজনকে আমরা অচিরেই গ্রেফতার করতে সক্ষম হবো।
র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন বলেন, জঙ্গি তৎপরতা অব্যাহত আছে, কিন্তু আমরাও আমাদের কর্মকাণ্ডও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। পাহাড়ি এলাকায় যে একটা জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ চলছিলো, সেটা আমরা ক্যাপচার করে ফেলেছি। সুতরাং তারা তেমন কিছু করার সুযোগ পাবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না।
আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ে বেড়েছে দুশ্চিন্তা
দেশে প্রথম জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রথম ঘটে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে। এরপর বিভিন্ন সময় ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা হলেও সফল হয়নি জঙ্গিরা। ত্রিশালের ৯ বছর পর দিনে-দুপুরে ফিল্মি স্টাইলে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ঢাকার আদালত চত্বরে।
গত ২০ নভেম্বর আদালত এলাকা থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের সহযোগীরা। শুনানি শেষে সিএমএম আদালতের হাজতখানায় নেওয়ার পথে দায়িত্বরত পুলিশের চোখে স্প্রে করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ওই ঘটনার পর পালাতে ব্যর্থ হওয়া অপর ১০ জঙ্গিকে রিমান্ডে নেওয়া হলেও এখনো সন্ধান মেলেনি পলাতক দুই জঙ্গির।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ২ জঙ্গি ছিনতাই হয়েছে এ ব্যপারে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আমরা বিশেষ অভিযান শুরু করেছি। এরই মধ্যে ওই জঙ্গিদের বেশ কয়েকয়েকজন সহযোগী এবং অন্য গ্রুপের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি জঙ্গিদেরও আমরা নাম ঠিকানা সংগ্রহ করতে পেরেছি, তাদেরকেও গ্রেফতার করতে পারবো।
র্যাব ডিজি এম খুরশীদ হোসেন বলেন, আমরা আত্মসমালোচনায় বিশ্বাস করি। আমি অবশ্যই আমার দুর্বলতা থাকলে স্বীকার করবো। দুই জঙ্গি পালিয়ে গেছে, এটা আমাদের ব্যর্থতা। দুইজন জঙ্গি চলে গেছে এবং হয়তো তারা দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করেই গেছে। তাদের এখনো ধরতে পারিনি, কিন্তু আমাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
তবে দুই জঙ্গির পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই উল্লেখ করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, কিছুদিন আগে দুই জঙ্গি পালিয়েছে। তারা কেন পালিয়েছে সেটা জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে বিষয়টি জানা যাবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। তবে এটা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২২
পিএম/জেএইচ