ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ পৌষ ১৪৩১, ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২ রজব ১৪৪৬

সালতামামি

অভ্যুত্থানে ২৯ প্রাণহানিতে উত্তাল সিরাজগঞ্জ

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪
অভ্যুত্থানে ২৯ প্রাণহানিতে উত্তাল সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জ: ২০২৪ সালজুড়ে নানা ঘটনায় আলোচিত ছিল সিরাজগঞ্জ। ট্রিপল মার্ডারসহ একাধিক খুন, চুরি, ছিনতাই, শিক্ষকের গুলিতে মেডিকেল ছাত্র আহত, নির্বাচনী সহিংসতা ও জুলাই বিপ্লবে হতাহতসহ নানা ঘটনাতেই সরব ছিল যমুনাপাড়ের এ জেলা।

অপরদিকে বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে প্রেম-বিয়ের একাধিক ঘটনাতেও আলোচিত ছিল সিরাজগঞ্জ।  

সপরিবারে মামাকে খুন করেন ভাগ্নে
বছরের শুরুতেই বাবা-মা ও মেয়েকে গলা কেটে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। ৩০ জানুয়ারি তাড়াশ পৌর এলাকার গোপাল জিউ মন্দির এলাকায় একটি বাসার দোতলার ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে বিকাশ সরকার (৪৫), তার স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার (৪০) ও মেয়ে তাড়াশ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী পারমিতা সরকার তুষির (১৫) গলা কাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই ঘাতক রাজীব কুমার ভৌমিককে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হাঁসুয়া ও লোহার রড উদ্ধার করা হয়। রাজীব নিহত বিকাশ সরকারের ভাগ্নে। তদন্তে বেরিয়ে আসে ৩৫ লাখ টাকা ঋণের দায় থেকে মুক্ত হতে একাই মামা বিকাশ চন্দ্র সরকারকে সপরিবারে হত্যা করেন রাজীব। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার দায় স্বীকার করে লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণও দেন আসামি রাজীব।  

শ্রেণিকক্ষে অস্ত্রধারী শিক্ষক, গুলিতে আহত মেডিকেল ছাত্র
সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রের পায়ে গুলি করে আলোচিত হন ডা. রায়হান শরীফ নামে এক শিক্ষক। ৪ মার্চ কলেজের তৃতীয় বর্ষের একাডেমি ভবনের চতুর্থ তলায় আইটেম পরীক্ষা চলাকালীন শিক্ষক রায়হান শরীফ উত্তেজিত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বকাবকির এক পর্যায়ে পিস্তল বের করে আরাফাত আমিন তমাল নামে এক ছাত্রের পায়ে গুলি করেন তিনি। ঘটনার পরই পুলিশ ডা. রায়হান শরীফকে গ্রেপ্তার করে। শ্রেণিকক্ষের টেবিল থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও একটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। পরে গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের পর তার চামড়ার ব্যাগ থেকে আরও একটি বিদেশি পিস্তল, ৮১ রাউন্ড তাজা গুলি, চারটি ম্যাগাজিন, দুটি বিদেশি কাতানা (ছোরা) ও ১০টি অত্যাধুনিক বার্মিজ চাকু উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ডা. রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী তমালের বাবা আব্দুল্লাহ আল-আমিন বাদী হয়ে হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন। অপরদিকে গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক আব্দুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে অপর একটি মামলা দায়ের করেন।  

এদিকে এ ঘটনার পর ডা. রায়হান শরীফ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রচুর অ্যাকশন সিনেমা দেখে নিজেকে ভিলেন মনে করে তৃপ্ত হতেন তিনি। সিনেমার ডায়ালগ দিতেন ক্লাসরুমে। নিজের ফেভারিট মুভির গান প্রজেক্টরে শোনাতেন। ক্লাসের কোনো ছাত্রের আচরণ পছন্দ না হলে পিস্তল বের করে শুট করে ভয় দেখাতেন। তার পারসোনাল একটি ব্যাগ থাকতো। ওই ব্যাগে এক বা দুটি পিস্তল, অনেকগুলি ছুরি, খুর অন্যান্য অস্ত্রও থাকতো। অস্ত্রের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ ছিল। তিনি ক্লাসে প্রবেশ করে ব্যাগ থেকে দু-একটি অস্ত্র বের করে টেবিলে রাখতেন। শিক্ষার্থীরা তার ক্লাসে ভয়ে থাকতো। কোনো শিক্ষার্থী তার ক্লাস মিস করলে অন্য শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাসে পাঠিয়ে তাকে ডেকে আনতেন। আসার পর তাকে ভর্ৎসনা করতেন। প্রতিদিনই ক্লাসে এসে কারও না কারও গায়ে হাত তোলা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।  

১১ হাজার টাকা ঋণের দায়ে কোলের শিশু রেখে খালেদা পারভীন জেলে
একটি বেসরকারি সংস্থার কাছে মাত্র ১১ হাজার ২০০ টাকা ঋণের দায়ে ঈদের আগের দিন তিন বছরের শিশুকন্যাকে রেখে জেলহাজতে যেতে হয় খালেদা পারভীন নামে এক হতদরিদ্র নারীকে। বেসরকারি সংস্থা উদ্দীপণের দায়ের করা মামলায় ১০ এপ্রিল পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায় তাকে। বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত হয়। জাতীয় ও স্থানীয় একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে তার পরিবারকে সহযোগিতা করা হয়। বাধ্য হয়ে মামলাটি তুলে নেয় উদ্দীপণ কর্তৃপক্ষ। ছয়দিন পর জামিনে মুক্ত হন তিনি। জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই তার তিন বছরের শিশুকন্যা ফাতেমাকে বুকে জড়িয়ে নেন।  

প্রসঙ্গত, বেসরকারি সংস্থা উদ্দীপণ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন খালেদা। ঋণের বেশকিছু টাকা পরিশোধ করলেও অভাবের তাড়নায় ১১ হাজার ২০০ টাকা বাকি ছিল। এদিকে দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পেতে ছয় মাস আগে স্বামীসহ ঢাকার পোশাক কারখানায় চাকরি নেন তিনি। আর ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় উদ্দীপণ এনজিও তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে। মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও বিষয়টি জানতেন না খালেদা পারভীন। ঈদের আগের দিন ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে এলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়।

বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকদের হাতে পরাজিত প্রার্থীর চাচা খুন
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আমিনুল ইসলাম সমর্থকদের হামলায় খুন হন পরাজিত প্রার্থী বদিউজ্জামান ফকিরের চাচা আব্দুল আলীম। ৮ মে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরপরই তার ওপর হামলা চালানো হয়। ১২ মে ঢাকার একটি হাসপাতলে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। নিহত আব্দুল আলিম বেলকুচি উপজেলার কামারপাড়া গ্রামের মৃত হায়দার আলী ছেলে।  

আধিপত্য বিস্তারের সংঘর্ষে প্রাণ গেল তিনজনের
কোরবানির ঈদের পরদিন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ সংঘর্ষে এক কিশোরসহ উভয়পক্ষের তিনজন নিহত হন। ১৮ জুন সকালে উপজেলার গালা ইউনিয়নের চর বর্ণিয়া গ্রামে সায়েম ও আখের গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। ঘটনার দিনই মারা যান ওই খোদাবক্সের ছেলে সানোয়ার হোসনে (৩৫) ও আব্দুস সোবহানের ছেলে তামিম হাসান গালিব। পরদিন ১৯ জুন রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফালাবিদ্ধ ফরহাদ হোসেন (৪০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়।  

গরুচুরির হিড়িক
২০২৪ সালে জেলায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায় গরু চুরির ঘটনা। বিশেষ করে জেলার প্রত্যন্ত উপজেলাগুলোতে সংঘটিত হতে থাকে গরুচুরি। জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত এ ৫ মাসেই ১৯টি গরু চুরি হয়। এসব ঘটনায় ৭৬টি গরু ও চারটি মহিষ চুরি হয়। সর্বোচ্চ ৪০টি গরু ও মহিষ চুরি হয়েছে তাড়াশে। এসব চুরির ঘটনায় একাধিক চোরচক্র গ্রেপ্তারও হয়।  

জুলাই বিপ্লবে ১৫ পুলিশসহ ২৯ জনের প্রাণহানি
কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই সরব ছিল সিরাজগঞ্জ। পুরো জুলাইজুড়ে প্রতিদিনই ছাত্র-জনতার বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচিতে সরব ছিল জেলা শহর। প্রতিদিন পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় অসংখ্য ছাত্র-জনতা আহত হন। ৪ আগস্ট সরকার পতন আন্দোলনে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সিরাজগঞ্জ শহর দখল করে নেন। ওইদিন শহরে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হামলায় তিন ছাত্রদল-যুবদল নেতাকর্মী নিহত হন। একইদিন রায়গঞ্জে এক সাংবাদিক ও পাঁচ আওয়ামী লীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্র-জনতা।  

অপরদিকে এনায়েতপুরে পুলিশের গুলিতে তিন ছাত্র-জনতা নিহত হন এবং ওসিসহ ১৫ পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরীর পুড়িয়ে দেওয়া বাসা থেকে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।  

প্রেমের টানে সিরাজগঞ্জে তুরস্ক ও চীনের যুবক
প্রেমের টানে তুরস্ক থেকে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার পারি দিয়ে মুস্তফা ফাইক নামে এক যুবক সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আসেন। তিনি ৪ নভেম্বর শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া ইউনিয়নের কাকিলামারি গ্রামের দলিল লেখক কামরুজ্জামান মানিকের মেয়ে মল্লিকাকে বিয়ে করেন। এ বিয়ের ঘটনাটি সিরাজগঞ্জসহ সারা দেশে আলোচিত ঘটনায় পরিণত হয়। তিন বছর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইন্সট্রাগ্রামে নিজের আইডিতে ছবি পোস্ট করেন মল্লিকা। সেই ছবি দেখে পছন্দ করে ফেলেন তুরস্কের যুবক মুস্তফা ফাইক। এরপর দুজনের মধ্যে কথা হয়। পরে তাদের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দীর্ঘদিনের প্রেমের পরিণতি দিতে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসেন মুস্তফা ফাইক।  

অপরদিকে কাজিপুরের অন্তরা খাতুন নামে এক পোশাককর্মীকে ভালোবেসে বিয়ে করেন চীন থেকে আসা চেং নাং নামে এক যুবক। উপজেলার বিয়ারা গ্রামের মেয়ে অন্তরা খাতুনের সঙ্গে মুসলিম রীতিতে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তিনি। গত ২২ নভেম্বর নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন করেন তারা।  

জানা যায়, অন্তরা গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। সেখানে একটি রেস্টুরেন্টে চীনা যুবক চেং নাং-এর সঙ্গে তার দেখা হয়। অন্তরাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেন চেং নাং। বেশ কয়েকবার অন্তরার বাড়িতে যান চেং নাং। এক পর্যায়ে দুজন-দুজনকে ভালোবেসে ফেলেন। চেং নাং বিয়ের প্রস্তাব দেন অন্তরাকে। পরে পারিবারিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই তাদের বিয়ে হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪
আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।