ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

বছরজুড়ে ভুগিয়েছে ডেঙ্গু, মৃত্যুতে হয়েছে রেকর্ড

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩
বছরজুড়ে ভুগিয়েছে ডেঙ্গু, মৃত্যুতে হয়েছে রেকর্ড

ঢাকা: বছরজুড়ে রাজধানীসহ সারা দেশেই ছিল ডেঙ্গু রোগের অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন। শহরকেন্দ্রিক মশাবাহিত এ রোগটি চলতি বছরে সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে।

সাধারণত গ্রীষ্মকালে ডেঙ্গু রোগের মৌসুম হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে সারা বছর জুড়েই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা গেছে। চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দেশের ইতিহাসে সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

অতীতের বছরগুলোতে শহরের বাসা-বাড়িতে আবাসিক ধরনের মশা (এডিস ইজিপটাই) ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটালেও বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের বুনো মশাও (এডিস এলবোপিকটাস) ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে কাজ করছে। গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ায় ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার জন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০০১ সালে আড়াই হাজার লোক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় এবং ৪৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালে ছয় হাজার রোগীর মধ্যে ৫৮ জন মারা যান। ২০০৩ সালে ৪৮৬ জনের মধ্যে ১০, ২০০৪ সালে চার হাজারের মধ্যে ১৩, ২০০৫ সালে এক হাজারের মধ্যে চার, ২০০৬ সালে দুই হাজারের মধ্যে মৃত্যু হয় ১১ জনের। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আড়াই হাজার ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও কারও মৃত্যু হয়নি।

২০১১ সালে দেড় হাজারের রোগীর মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে ৬৭১ জনের মধ্যে একজন, ২০১৩ সালে প্রায় দুই হাজারের মধ্যে দুজন রোগী মারা যান। ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে কেউ মারা যাননি। ২০১৫ সালে তিন হাজারের মধ্যে ছয়জন, ২০১৬ সালে ছয় হাজারের মধ্যে ১৪ জন, ২০১৭ সালে তিন হাজারের মধ্যে আটজন, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জনের মধ্যে ২৬ জন, ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জনের মধ্যে ১৭৯ জন মারা যান। ২০২০ সালে দেড় হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয় চারজনের। আর ২০২১ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সাড়ে ২৮ হাজার, মারা যান ১০৫ জন। ২০২২ সালে সর্বমোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন এবং মোট ২৮১ জন মারা যান। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে ২৮১ জনের মৃত্যু ছিল দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।

অপরদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৫৬৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, ছয়জন মারা গেছেন। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত হন ১৬৬ জন, মৃত্যু হয় ৩ জনের, মার্চে আক্রান্ত ১১১ জন, এপ্রিলে আক্রান্ত ১৪৩, মৃত্যু দুইজন, মে মাসে আক্রান্ত এক হাজার ৩৬ জন, মৃত্যু দুই জনের, জুন মাসে আক্রান্ত পাঁচ হাজার ৯৫৬ জন, মৃত্যু ৩৪ জন, জুলাই মাসে আক্রান্ত ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন, মৃত্যু ২০৪ জন। আগস্ট মাসে আক্রান্ত ৭১ হাজার ৯৭৬ জন, মৃত্যু ৩৪২ জন, সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন, মৃত্যু ৩৯৬ জন, অক্টোবর মাসে আক্রান্ত ৬৭ হাজার ৭৬৯ জন, মৃত্যু ৩৫৯ জন, নভেম্বরে আক্রান্ত ৪০ হাজার ৭১৬ জন, ২৭৪ জনের মৃত্যু হয়। ডিসম্বর মাসের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট আট হাজার ২৬৭ জন এবং ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

চলতি বছরের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তিন লাখ ২০ হাজার ১৫৮ জন। এর মধ্যে ঢাকাতে এক লাখ নয় হাজার ৭৪৩ জন ও সারা দেশে (ঢাকা সিটি ব্যতীত) দুই লাখ ১০ হাজার ৪১৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।

একই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৬৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকাতে ৯৭৫ জন এবং সারা দেশে (ঢাকা সিটি ব্যতীত) ৭১৭ জন মারা যান। চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব বছর থেকেও বহুগুণ বেড়েছে।

বছরব্যাপী ডেঙ্গুর সংক্রমণ বিষয়ে জানতে চাইলে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, এডিস মশার আবাসিক ধরনের এবং বুনো ধরন বর্তমানে দুটোই ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে শহরের আবাসিক মশাগুলোই ডেঙ্গুর বাহক। কিন্তু ২০১৯ সালের মহামারির সময় যখন ডেঙ্গু মশা সারা দেশে ছড়িয়ে গেল, তখন বন্য মশাগুলোও এডিসের বাহকে রূপান্তরিত হয়।

তিনি বলেন, বন্য মশা ঝোপ ঝাড়, গাছের দুই ডালের মাঝে, গাছের ফাঁকফোকরে, পাতায় জমে থাকা পানিতে বংশ বিস্তার করে থাকে। শীতকালে শিশির কনা বা কুয়াশা থেকে জমে থাকা পানিতেও এই বন্য ধরনের এডিস মশা ডিম পাড়তে এবং বংশবিস্তার করতে পারে। এসবের মধ্যে দিয়েই আমরা বুঝতে পারছি যে, এডিস মশার প্রজনন এখন সারা বছরব্যাপী হচ্ছে এবং ডেঙ্গুর সংক্রমণ সারা বছরব্যাপী তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার এ বিষয়ে বলেন, দেশে এখন কিছু পার্মানেন্ট কন্টেইনার তৈরি হয়েছে। প্রচুর মাল্টিস্টরয়েড বিল্ডিং হয়েছে। সারা বছরই এসব বিল্ডিংয়ে গাড়ির ধোয়া হয়। আবার কিছু স্থানে পানির সংকট থাকায় মানুষ ব্যবহারের পানি বিভিন্ন পাত্রে জমিয়ে রাখে। সেখানেও আমরা এডিস মশা পাচ্ছি। নির্মাণাধীন ভবনেও প্রচুর মশা আমরা পাচ্ছি। এ যে তিনটা মশার ব্রিডিং প্লেসের কথা বললাম, এগুলোর কার্যক্রম সারা বছরব্যাপী চলমান থাকে।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত মশা শীত ও গ্রীষ্ম মানছে না, সারা বছরব্যাপী ডিম পাড়া প্রজনন এবং বংশবিস্তার করছে। এসব কারণেই দেশে এখন ডেঙ্গু সংক্রমণ সারা বছরব্যাপী চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩
আরকেআর/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।