ঢাকা, সোমবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

সালতামামি ২০২৩

প্রবাসী আয়ে হুন্ডির থাবা, রক্ষার প্রচেষ্টা ছিল বছরজুড়ে

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৩
প্রবাসী আয়ে হুন্ডির থাবা, রক্ষার প্রচেষ্টা ছিল বছরজুড়ে

ঢাকা: শেষ হতে চলা ২০২৩ সালের পুরোটা জুড়ে প্রবাসী আয়ে থাবা বসিয়েছে হুন্ডি। এ গ্রাস থেকে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের পাঠানো আয় রক্ষায় করা হয় নানা রকম প্রচেষ্টা।

কিছুটা ফল মিললেও হুন্ডিমুক্ত করার সরকারের যে চেষ্টা সেটি মোটামুটি বিফলে গেছে।

প্রবাসীদের কষ্টার্জিত আয় রক্ষা সরকারের পক্ষ থেকে যত কৌশল গ্রহণ করেছে, সেটিও সিঁদ কাটার চেষ্টা ছিল পুরো বছর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে গত ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ মাস ২২ দিনে প্রবাসী আয় এসেছে দুই হাজার ১৪৯ কোটি ৫৩ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার, যেটি ২০২২ সালের চেয়ে বেশি। আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণের বছর ২০২০ ও মহামারি প্রশমিত হয়ে আসা বছর ২০২১ সালে আসা সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের চেয়ে কম।

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) বছরভিত্তিক সংরক্ষণকৃত হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে প্রবাসী আয় আসে ২ হাজার ১৭৫ কোটি ১২ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। ২০২১ সাল আসে দুই হাজার ২০৭ কোটি ৮ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার এবং ২০২২ সালে আসে দুই হাজার ১২৮ কোটি  ৫২ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার।

বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি শুরু হলে প্রবাসীদের দেশে ফিরতে হয়। নতুন করে চাকরি নিয়েও বিদেশে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। যারা বিদেশে ছিলেন অর্জিত প্রবাসী আয় সঙ্গে করে নিয়ে দেশে ফিরেন। এর ফলে ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পায়। আবার করোনা মহামারী কাল-পূর্ব স্বাভাবিক সময়ে বছরভিত্তিক সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় ছিল এক হাজার ৮৩৫ কোটি  ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে এসেছিল এ প্রবাসী আয়। আর আগের ১০ বছরে এক হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে এক হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রবাসী আয় এসেছে।  

এ হিসাব বলছে ২০২৩ সালে প্রবাসী আয় কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু যে হারে বাড়ার কথা, সেটি বাড়েনি। তথ্য বলছে, চলতি বছর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ বিদেশে কাজের সন্ধানে গেছেন। গত জানুয়ারি-নভেম্বর ১১ মাসে বিদেশে যাওয়ার মানুষের সংখ্যা ১২ লাখ ১০ হাজার ২৫৬ জন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ কোনো বছরেই বিদেশে কাজের সন্ধানে যায়নি। সে হিসেবে ২০২৩ সালের স্বাভাবিক সময় প্রবাসী আয় বাড়লেও যতটুকু আসার প্রত্যাশা ছিল, সেটি হয়নি।

প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার কারণ- হুন্ডি। চলতি বছর বেশি মানুষ বিদেশে কাজের জন্য গেলেও হুন্ডির কারণে প্রবাসী আয় বাড়েনি। বাংলাদেশে ঘোষিত ডলারের দাম বেশি পাওয়া প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার না করে অবৈধ পথে টাকা পাঠানো বাড়িয়ে দেয়। ফলে প্রবাসীয় আয়ে টান পড়ে।

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে পণ্য ও সেবা অপ্রতুল হয়ে যায়। তৈরি হয় মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশে এর দ্বি-মুখি প্রভাব পড়ে। একদিকে আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ে, বাড়ে দেশে উৎপাদিত পণ্যেরও। এতে আগের একই পণ্য আমদানি করতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেশি মূল্য গুণতে হয়। পাচার হয় দেশিও অর্থও। যার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা।

প্রবাসী আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈধভাবে দেশে আনতে নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। চলতি বছরের মাঝামাঝি প্রবাসী আয় পাঠাতে সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়ে দেয় সরকার। প্রবাসীদের সম্মাননার হার বাড়ানো হয়, দেশে স্বজনের কাছে যাতে দ্রুত টাকা আসে সে জন্যও সে ব্যবস্থাও গ্রহণ করে সরকার। কমানো হয় খরচও।

সর্বশেষ প্রবাসী আয়ের ডলারের দাম বাড়িয়ে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়। প্রণোদনা ২ দশমিক ৫০ শতাংশের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আরও ২ দশমিক ৫০ শতাংশ পয়সা দেওয়ার পথ তৈরি করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বাইরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার কিনতে পারে-বিক্রিতে সীমা বেঁধে দিয়ে সে সুযোগও করে দেয় সরকার। ফলে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সর্বনিম্নে নেমে আসা প্রবাসী আয় দ্রুতই বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধি পায় চলতি বছরের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে আসা প্রবাসী আয়। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে চলতি ২০২৩ সালের প্রবাসী আয়ে।

প্রবাসী আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে না আসার মূল কারণ পাচারকারী। তারা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে। যে কারণে প্রবাসী আয় পুরোপুরি দেশে আসছে না বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউিটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রবাসী আয় লিকেজ বন্ধ করতে হলে ব্যবস্থাপনা কঠোর করতে হবে। পাচারকারীরা হলো প্রশাসনের বড় বড় কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িতরা, নিয়ন্ত্রকরা। দেশে ভালো ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে সুযোগ সন্ধানীরা সুযোগ নিচ্ছে। এভাবেই তারা দেশের সর্বনাশ করে দিচ্ছে। এক শ্রেণির উচ্চবিত্ত আছে যারা বিভিন্ন দেশে সম্পদ তৈরি করেছিল। এক সময় ছেলে-মেয়েদের বিদেশে পাঠিয়েছিল, শেষ বয়সে দেশের সব বিক্রি করে বিদেশে ছেলে-মেয়ের কাছে নিয়ে চলে যাচ্ছে। কখনো কখনো মৃত্যুর পরও ছেলেমেয়েরা নিয়ে চলে যাচ্ছে। টাকা পাচার করছে রাজনীতিকরা।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্রামের যে মানুষটি ধার-দেনা করে, সহায়-সম্বল বিক্রি করে বা বন্ধক রেখে বিদেশে কাজের সন্ধানে গেল, রোজগার করলো- সেই মানুষটির অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রাই পাচারকারীরা ব্যবহার করছে। হুন্ডিকারবারিরা দেশে সরকার নির্ধারিত ডলার চেয়ে বেশি দামে কিনছে। সে টাকাই পাচারকারীর বিদেশে থাকা স্বজনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। হুন্ডির বাংলাদেশি এজেন্টরা দেশের পাচারকারীর সম্পদ ক্রেতার কাছে টাকা নিয়ে প্রবাসীর দেশের স্বজনদের কাছে দিচ্ছে।  

এই হুন্ডি কারবারের কারণে প্রবাসে থাকা একজন কর্মীর টাকা দেশে স্বজনের কাছে পৌঁছলেও বা দেশের সম্পদটি দেশে থাকলেও প্রবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রাটি পুরোপুরি দেশে আসছে না। ক্ষতি হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের, ক্ষতি হলো বাংলাদেশের। এভাবেই প্রবাসী আয়ে লিকেজ হচ্ছে। ফলে জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও, দেশে প্রবাসী আয়ে প্রত্যাশা মতো বাড়ছে না বলে মনে করেন বহুজাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান আইএমএফ’র সাবেক এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বলেন, প্রবাসী আয় পুরোপুরি ব্যাংকিং চ্যানেল দেশে আনতে হলে ব্যবস্থাপনার কঠোর করতে হবে।

বিদায়ী ২০২৩ সাল জুড়ে দেখে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা রকম নীতি ও প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে। এসব উদ্যোগ পুরোপুরি সফল না হলেও প্রবাসী আয় কিছুটা প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৩
জেডএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।