ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৪ পৌষ ১৪৩১, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

ট্রলার ডুবি, জেলে নিখোঁজ, অপহরণ-হত্যা দিয়েই বছর পার

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০২৪
ট্রলার ডুবি, জেলে নিখোঁজ, অপহরণ-হত্যা দিয়েই বছর পার

পাথরঘাটা (বরগুনা): বিদায় নিয়েছে-২০২৩। আসছে নতুন বছর।

দিনপঞ্জিকার শেষ পাতাটি গেছে উল্টে। নিশি অবসানে শুরু হয়েছে ইংরেজি নতুন বর্ষ ২০২৪ সালের প্রথমদিন। সদ্যই বিদায় নিচ্ছে পুরোনো খ্রিষ্ট বছর। ৩১ ডিসেম্বর কৃষ্ণরাত, পরদিন পূর্বাকাশে দেখা  গেলো নতুন বছরের সূর্য। তবে পৌষের কুয়াশামোড়া প্রকৃতির কারণে শিশির জমা দূর্বাঘাসে এবার সেই সূর্যালোকের ছোঁয়া নাও লাগতে পারে। কিন্তু ভোরের আলো ফুটুক বা কুয়াশাচ্ছন্নই থাকুক; বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে মহাকালের পরিক্রমায় এরই মাঝে বিদায় নিলো আরও একটি বছর।

আনন্দ-বেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-প্রবঞ্চনার হিসাব-নিকাশ পেছনে ফেলে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় সবাই। নতুন স্বপ্নে পাখা মেলবে-সোনালি প্রত্যাশা। নানান কাজের ফিরিস্তি লেখা নিত্যসঙ্গী পকেট ডায়রিটাও সাবেক হবে। হিসাব-নিকাশও হবে।  আর এ হিসাব-নিকাশে সারাদেশের মতো বরগুনার পাথরঘাটায় রয়েছে আলোচিত ঘটনা। চাঞ্চল্যকর হাসিব হত্যা, সাগরে জেলে নিখোঁজ, জেলেদের মরদেহ উদ্ধার, ঘূর্ণিঝড়সহ একাধিক আলোচিত ঘটনা দিয়ে বিদায় নিলো ২০২৩ সাল।

পাথরঘাটায় ‘ভূত আতঙ্ক’ নিয়ে ধুম্রজাল

বরগুনার পাথরঘাটায় একটি গ্রামে ভূত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কের পাশাপাশি মানসিক বিপর্যস্তের মধ্যে পড়েছিলেন অনেকে।  পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি ভাইরাল হয়। ভূত আতঙ্ক নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়েছিল। এক পক্ষ বলেছিলো, ভূত বা শয়তানের আখড়া রয়েছে এলাকায়, অন্য পক্ষ বলছিলো এলাকায় কোনো ভূত নেই, স্থানীয় মাদক ও চুরির কৌশল করতেই এই অপপ্রচার। এ নিয়ে ২০২৩ সাল বেশ চাঞ্চল্যকর ছিল।

দশ জেলের মরদেহ উদ্ধার

বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া এবং মাছ ধরার সময় জলদস্যুদের গুলি থেকে প্রাণে বাঁচতে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়া তিনজনের মরদেহ উদ্ধার হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময় বজ্রপাত ও ট্রলার ডুবে আরও সাত জেলের মৃত্যু হয়। দুই ট্রলারের চাপে বাবার সামনেই ছেলের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে‌ ২০২৩ সালে।

একই বছর অর্থাৎ বছরের শুরুতে ছোট ভাইয়ের জানাজার সালাম ফেরানোর পরই মিলে বড় ভাইয়ের মরদেহ। এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বলেশ্বর নদে নৌকাডুবির ঘটনার ছয় দিন পর মেলে ছোট ভাই বাইজিদের মরদেহ। তার জানাজার সালাম ফেরানোর পরই খবর আসে বড় ভাই ইউসুফেরও মরদেহ পাওয়া গেছে। একসঙ্গে নিখোঁজ হয়ে নৌকা ডুবে তাদের মৃত্যু হয়। এর ছয় দিন পর ছোট ভাইয়ের মরদেহ পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মেলে বড় ভাইয়ের মরদেহ। পর পর দুই ভাইয়ের মরদেহ পাওয়ার ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। বুধবার (১১ জানুয়ারি) সকাল ৮টায় পদ্মা গ্রামের আমিন বেপারীর ছেলে বাইজিদের (১৭) জানাজা হয়। তাদের বাড়ির সামনেই মাঠে জানাজা পড়ানো হয়। ঠিক সালাম ফেরানোর পর পরেই খবর আসে ইউসুফ বেপারীর (২৩) মরদেহ বাড়ির পাশেই বলেশ্বর নদের চরে পাওয়া গেছে। মুসল্লিরা তাৎক্ষণিক বাইজিদের মরদেহ দাফন না দিয়েই চরে গিয়ে ইউসুফের মরদেহ দেখতে পান।

অপরদিকে বঙ্গোপসাগরে চলতি বছরে অর্ধগলিত ১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় বরগুনার পাথরঘাটা থেকে সাগরে যেতে গড়িমসি করে অনেক জেলে। একে তো কিনারাহীন অথৈ সাগরে জেলেদের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে, তার মধ্যে নতুন করে দস্যুদের তাণ্ডব এখন‌ নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে পাথরঘাটা থেকে ৮০ কিলোমিটার পূর্বে বঙ্গোপসাগরে পায়রা বন্দর থেকে পশ্চিমে বয়া এলাকায় মাছ ধরা একটি ট্রলারে দস্যুদের হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ট্রলারে ১৮ জেলের ওপরে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে ৯ জেলেকে গুরুতর জখম করে দস্যুরা। এ নিয়ে জেলেসহ উপকূলের মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয়।

ভারত থেকে কারাভোগ শেষে দেশে আসে ১৭ জেলে

গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সময় ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হওয়া, ঝড়ের কবলে পড়ে ভাসতে ভাসতে ভারতের জলসীমায় প্রবেশ করার অপরাধে ছয় মাস কারাভোগ করার পর দেশে ফিরে এসেছেন এফবি ফাতেমা নামে একটি ট্রলারের ১১ জেলে। মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৬টায় সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফেরেন তারা। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে বাংলাদেশি ট্রলার ভারতীয় জলসীমায় অনুপ্রবেশ করার অপরাধে বাংলাদেশি ছয় জেলে প্রায় ৪ বছর কারাভোগ শেষে দেশে ফিরেছেন। ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর ফিরে আসেন তারা।

‘মোখা মোগো এলাকায় আইবে না ইনশাআল্লাহ’

গেলো বছরের বড় ধরনের দুটি বন্যা হয়। যার নাম ঘূর্ণিঝড় মোখা ও মিধিলি। ঘূর্ণিঝড় মোখা পাথরঘাটার উপকূলে তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও মিধিলিতে জেলে নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আতঙ্কে দেশ। বিভিন্ন ধরনের সংকেতসহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের সতর্ক করছেন আবহাওয়াবিদরা। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস, সতর্কবার্তার বাইরেও নিজের অভিজ্ঞতাকে বড় করে দেখেছিলেন বরগুনার পাথরঘাটার জেলে আবদুল জব্বার হাওলাদার।

তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছিলেন, মোখা পাথরঘাটায় আসবে না, কোনো ক্ষয়ক্ষতিও করবে না। কেন এমনটা বলছেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উতরা বাতাস আইছে... পানি আইবে না... বাতাসও অইবে না! ইনশাআল্লাহ। আমরা আবহাওয়া বাস্তবে দেখি, বাস্তবতার প্রেক্ষিতে কথা বলি। ’ তার অভিজ্ঞতাই বাস্তবে রূপ নিয়েছিলো, মোখা আঘাত হানেনি পাথরঘাটায়।

ঘূর্ণিঝড় মিথিলিতে এখনো নিখোঁজ ২৫ জেলে। তারা বেঁচে আছে না মারা গেছে কেউ জানে না। এতো দিনেও সন্ধান না পাওয়ায় তাদের ভাগ্য অনিশ্চিত।

ডার্ক ওয়েবে’ দিতেই হত্যা, গুগল ম্যাপ দেখে নিরাপদে মরদেহ গুম হাসিবকে

বরগুনার পাথরঘাটায় মাদরাসা ছাত্র হাসিবুল ইসলামকে (১৩) অপহরণের পর হত্যা করা হয়। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটজনের নামে অপহরণসহ হত্যা মামলা করেছে হাসিবুলের বাবা শফিকুল ইসলাম।

মূলহোতা নোমানসহ আটজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের পর রহস্য উদ্‌ঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদে নতুন নতুন তথ্য উঠে আসে। কিলিং মিশনের তথ্য, ভিডিও চিত্র ধারণ করে ডার্ক ওয়েবে আপলোড করতে এবং নিজেই একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে নগদ টাকার প্রয়োজনে এ ঘটনা ঘটিয়েছিলো।  

ডার্ক ওয়েবে এসব কিলিং মিশনের ভিডিও আপলোড করে টাকা উপার্জনের জন্য হাসিবকে হত্যা করে এবং অপহরণের পর থেকে কিলিং মিশনের প্রতি মুহূর্তের ভিডিও করে ঘাতক নোমান। টাকা উপার্জনের জন্য নিজেই ডার্ক ওয়েবের মতো ওয়েবসাইট করতে নগদ তিন লাখ টাকার মুক্তিপণের জন্য ওই ভিডিওর কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ হাসিবের বাবা শফিকুল ও চাচা মনিরের মোবাইলে পাঠায় নোমান। নোমান নিজের স্ত্রীর বোরখা পড়ে এবং ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে নারী সেজে হাসিবের মরদেহ পাথরঘাটা পৌর শহর থেকে অটোরিকশায় করে নিয়ে যায় শ্বশুরবাড়িতে। পরে গুগল ম্যাপ দেখে নিরাপদে মরদেহ গুম করে ঘাতক নোমান। ওই মামলায় সব আসামিই জেল হাজতে আছে। মামলা তদন্তাধীন। সবশেষে ২৫ ডিসেম্বর পাথরঘাটা গোরস্থান হাফেজিয়া মাদরাসার মাসুদ রানা নামে এক ছাত্র নিখোঁজ রয়েছে।  

পুরো বছরটাই ছোট বড় মিলিয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা জন্ম হয়েছে বরগুনার পাথরঘাটায়।  

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, এখনো অনেক জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। ভারতের কারাগারে বছরের পর বছর ধরে আমাদের জেলে কারাভোগ করেছেন। কিন্তু তাদের ভাগ্য আইনি জালে বদ্ধ; সরকারের দৃষ্টি কামনা করছি।

পাথরঘাটা থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, নিখোঁজ মাদরাসা ছাত্রের অনুসন্ধান চলছে। এর আগে হাসিব হত্যা মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। অপরাধী আটজন‌ জেল হাজতে রয়েছে। হাসিব অপহরণের পর হত্যার করে মরদেহ গুম হওয়ায় এলাকায় আতঙ্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে মাসুদ রানা নিখোঁজ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।